হোম > বিশ্লেষণ

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে কার দুর্বলতা কোথায়

রাজিউল হাসান, ঢাকা

ছবি: সংগৃহীত

ইরান-ইসরায়েল সংঘাত গতকাল শনিবার নবম দিনে গড়িয়েছে। এই ৯ দিনে দুপক্ষই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে, যদিও ইরানের ক্ষয়ক্ষতি ইসরায়েলের তুলনায় অনেক বেশি। অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে চলেছে। অবশ্য যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়ালে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।

ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি বন্ধের ঘোষিত লক্ষ্য নিয়ে ১৩ জুন দেশটিতে বিমান হামলা শুরু করে ইসরায়েল। আক্রান্ত হওয়ার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে ইরান পাল্টা জবাব দিতে শুরু করেছে। তবে ইরান কেবল ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে যাচ্ছে; একটিও যুদ্ধবিমান ওড়ায়নি। পক্ষান্তরে ইসরায়েল ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে, এমন খবর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে দেখা যায়নি এই ৯ দিনে। অর্থাৎ তারা ড্রোন আর যুদ্ধবিমানে ভর করে যুদ্ধ করছে। এই অবস্থায় প্রশ্ন উঠেছে, ইরানের যুদ্ধবিমান না ওড়ানো কিংবা ইসরায়েলের ভূমি থেকে ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র না ছোড়া কি কোনো কৌশল, নাকি সীমাবদ্ধতা?

ইরানে এই হামলার প্রস্তুতি ইসরায়েল বহুদিন ধরে নিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রও সক্রিয়ভাবে এই প্রস্তুতি ও পরিকল্পনায় জড়িত। মধ্যপ্রাচ্যের বিগত কয়েক বছরের ঘটনাপ্রবাহ এক সুতায় গাঁথলেই বিষয়টি আঁচ করা যায়। লিবিয়ায় মুয়াম্মার গাদ্দাফির পতন, সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতন এসব ঘটনাপ্রবাহের মাত্র কিছু অংশ। এ ছাড়া আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সখ্য গড়ে তুলতে যুক্তরাষ্ট্রের সক্রিয় প্রচেষ্টাও ছিল গত কয়েক বছরে লক্ষণীয়। ফলে এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র আরব দেশগুলো ইরানে ইসরায়েলি হামলার শুধু নিন্দাই জানাচ্ছে; আর কিছু করছে না তারা। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালালেও এই দেশগুলোর পক্ষ থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে না, এমনটি ধরে নেওয়া যায়।

এরপরও ইরানের কিছু মিত্র মধ্যপ্রাচ্যে এখনো রয়েছে, যেমন গাজার হামাস, ইয়েমেনের হুতি ও লেবাননের হিজবুল্লাহ। এ ছাড়া ইরাক ও সিরিয়ায় ইরানের সমর্থনপুষ্ট কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী রয়েছে। তবে হামাস ও হিজবুল্লাহ ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে পর্যুদস্ত। হুতিরাও নিয়মিত লোহিত সাগর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার শিকার হচ্ছে। কাজেই ইরান মধ্যপ্রাচ্যে এখন মূলত একাই লড়ে যাচ্ছে।

ইসরায়েলের দুর্বলতা কী

সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারের পতনের পর সেখানে পশ্চিমা-সমর্থিত সাবেক বিদ্রোহী গোষ্ঠী ক্ষমতায় রয়েছে। দেশটির ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে আহমেদ আল-শারা। আল-কায়েদার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কারণে তিনি একসময় যুক্তরাষ্ট্রের হাতে বন্দী ছিলেন। সেখান থেকে মুক্ত হয়ে ২০১২ সালে আল-কায়েদার সহযোগিতায় গড়ে তোলেন আল-নুসরা ফ্রন্ট। পরে এই বিদ্রোহী গোষ্ঠী আন্তর্জাতিক জঙ্গীগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের (আইএস) সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়।

২০১৬ সালে আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন আল-শারা। তারপর তাঁর নেতৃত্বেই গত বছরের ডিসেম্বরের শুরুতে বাশার আল আসাদ সরকারের পতন ঘটে। আল-শারা সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট হন। আসাদ সরকারের এই পতনে পশ্চিমা প্রচ্ছন্ন সমর্থন ছিল বলে ধারণা করা হয়। তাই সিরিয়ায় পশ্চিমাঘনিষ্ঠ সরকার থাকায় ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো খুব সহজে সেখানে জ্বালানি ভরে নিতে পারছে।

ইসরায়েল সেই অর্থে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ছে না। তাহলে কি ইসরায়েলের ভান্ডারে ক্ষেপণাস্ত্র নেই? অবশ্যই রয়েছে এবং সেগুলো অত্যাধুনিকও। কিন্তু ইসরায়েলকে সেই ক্ষেপণাস্ত্রের বেশির ভাগ ব্যবহার করতে হচ্ছে আত্মরক্ষায়। ইসরায়েলের প্রায় চারপাশ ঘিরে লেবানন, জর্ডান, মিসর, গাজা ও পশ্চিম তীরের অবস্থান। ইসরায়েলের হাইফা বন্দর দাঁড়িয়ে রয়েছে ভূমধ্যসাগরের তীরে। দক্ষিণ লেবানন থেকে হিজবুল্লাহ এবং গাজা থেকে হামাস প্রায়ই রকেট হামলা চালায়। তাই ইসরায়েলের সাত ধরনের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে এসব হামলা প্রতিহত করতে সার্বক্ষণিক সক্রিয় থাকতে হয়। আর এখন ব্যতিব্যস্ত থাকতে হচ্ছে ইরানি ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে।

ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত অসীম নয়। মনে রাখতে হবে, একেকটি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে অনেক সময় দুই বা ততোধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়তে হয়। তাই ইসরায়েলের বেশির ভাগ ক্ষেপণাস্ত্র এখন ব্যয় হচ্ছে আত্মরক্ষায়। কিন্তু সেই সামর্থ্য দিন দিন কমছে। এরই মধ্যে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন আগের তুলনায় কম ঠেকাতে পারছে ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। গতকাল ইরানের দুটি ড্রোন বিনা বাধায় ইসরায়েলে আছড়ে পড়েছে। বলা হচ্ছে, ক্ষেপণাস্ত্রগুলোও এখন আগের তুলনায় কম বাধার মুখে পড়ছে। তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, ইসরায়েলের সামর্থ্যও কমছে। এর আভাস পাওয়া যায় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর তৎপরতায়। তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে এই যুদ্ধে সরাসরি জড়াতে উঠেপড়ে লেগেছেন।

ইরানের দুর্বলতা কী

ইরানকে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই অর্থনৈতিক চাপ সামাল দিতে হচ্ছে। পরমাণু কর্মসূচি এবং কথিত সন্ত্রাসবাদের অভিযোগে একের পর এক পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞায় তাদের অর্থনীতি ধ্বংসের কিনারে। ইরান যে আক্রান্ত হবে, তা তার শাসকগোষ্ঠী আগে থেকেই জানে। সে জন্য চার দশক ধরে তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু সেই চেষ্টা করতে গিয়ে তাদের অর্থনীতি ধসে গেছে। ইরানের বহরের বেশির ভাগ যুদ্ধবিমান ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগেকার। বিপ্লবের পর নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক সংকটের কারণে তারা নতুন করে যুদ্ধবিমান কিংবা আধুনিক সমরাস্ত্র কিনতে পারেনি বললেই চলে।

ইরান ও ইসরায়েল ভূখণ্ডের মধ্যে যেখানে দূরত্ব সবচেয়ে কম, তাও ২ হাজার কিলোমিটারের বেশি। ইরান থেকে যুদ্ধবিমান উড়লে তাকে ইরাক ও জর্ডানের ওপর দিয়ে গিয়ে ইসরায়েলে আঘাত হানতে হবে। জর্ডানকে এড়াতে চাইলে দূরত্ব আরও বেড়ে যাবে। যুদ্ধবিমানকে তখন ইরাক, সিরিয়া ও লেবাননের ওপর দিয়ে উড়ে যেতে হবে। ইরানের কোনো স্টিলথ যুদ্ধবিমান নেই। তাদের চার দশকের বেশি সময়ের পুরোনো যুদ্ধবিমানগুলোর এসব দূরত্বের কোনোটিই পাড়ি দেওয়ার সক্ষমতা নেই। তা ছাড়া ইরাক ও সিরিয়ায় এখন আর ইরানের মিত্র সরকার নেই। জর্ডান নিরাপত্তার স্বার্থে ইরান কিংবা ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান নিজের আকাশসীমায় ঢুকতে দেবে না। ফলে ইরানের যুদ্ধবিমানের জ্বালানি নেওয়ার সুযোগ নেই ইসরায়েলে অভিযান চালানোর ক্ষেত্রে।

এ কারণেই ইরানের জন্য পাল্টা আক্রমণের সহজ কৌশল হয়ে দাঁড়িয়েছে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র। ইরানের নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি বেশির ভাগ ড্রোন আত্মঘাতী। এগুলো বোমা বহন করে লক্ষ্যবস্তুতে আছড়ে পড়ে বিস্ফোরিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড়ের গহিনে থাকা ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলো ধ্বংস করার সামর্থ্য ইসরায়েলের কোনো দিনই ছিল না। সেই অসাধ্য তাকে সাধন করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতায়। কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘কূটনীতিকে’ আরও সুযোগ দিতে চান। এ কারণে তিনি দুই সপ্তাহ সময় নিয়েছেন। এখন দেখার বিষয়, এই দুই সপ্তাহ ইরান ও ইসরায়েল কীভাবে পার করে।

চীন চাইলে এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে পারে, কিন্তু কীভাবে

‘ডেথ সেলে’ ইমরান খান—ক্রিকেট বিশ্বের নীরবতা নিয়ে প্রশ্ন

ইরান ও ইসরায়েলে সমানতালে চলছে যুদ্ধের প্রস্তুতি

পাকিস্তানকে এফ-১৬ আধুনিকীকরণের প্যাকেজ, ভারতকে কী বার্তা দিতে চান ট্রাম্প

ডার্ক ফ্লিট: নিষেধাজ্ঞা এড়িয়ে যেভাবে চলে ইরান ও ভেনেজুয়েলার তেল পাচার

এআই চাকরি কেড়ে নিচ্ছে আমেরিকায়, কিন্তু নিয়োগ বাড়াচ্ছে ভারতে—কীভাবে

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নিরাপত্তা কৌশল এশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ না সম্ভাবনা

শত বছর আগে জাপানের কাছে হারের বদলা চান সি চিন পিং!

কোন দেশে সম্পদ ও আয়ের বৈষম্য সর্বাধিক, বাংলাদেশের চিত্র কেমন

যুদ্ধক্ষেত্রে কতটা দক্ষ ইতালির জঙ্গি বিমান ইউরোফাইটার টাইফুন