থাইল্যান্ডের এবারের নির্বাচন নানা দৃষ্টিকোণ থেকেই ঐতিহাসিক। বছরের পর বছর সেনাশাসনে পর্যুদস্ত দেশটিতে এবার গণতন্ত্র বুঝি বুকভরে শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পেল! গতকাল রোববার (১৪ মে) জাতীয় নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল তা-ই বলছে। আনকোরা বিরোধী দল মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি) ভোটে সবচেয়ে এগিয়ে; এরপর রয়েছে পুরোনো দল থাকসিন সিনাওয়াত্রার ফিউ থাই। ৫০০ আসনের পার্লামেন্টে এই দুই দল মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে। ক্ষমতাসীন সেনা-সমর্থিত ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টি গোহারা হেরেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই চিত্র সত্যিই বিস্ময়কর। বছরের পর বছর ধরে ক্ষমতার কলকাঠি নাড়া সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থীদের এই উত্থান ঐতিহাসিক। কীভাবে এই ঐতিহাসিক কাণ্ড ঘটল, তা জানতে হলে একটু পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।
নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কয়েক দিন আগের কথা। থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের শহরতলি থেকে একটু দূরের এক ছোট্ট দোকানঘরে দেখা যাচ্ছে কয়েকজন তরুণ ও যুবক ভোটের লিফলেট প্যাকেটবন্দী করছেন। উদ্দেশ্য, আশপাশের এলাকায় লিফলেটগুলো বিতরণ করা। এই তরুণেরা তাঁদের পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালানোর জন্য স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন।
আইস হচ্ছে, থাইল্যান্ডে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির তরুণ প্রার্থীদের একটি দল। এদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার—থাইল্যান্ডকে সামরিক থাবা থেকে বের করে আনা ও কোমরভাঙা গণতন্ত্রকে সুস্থ করে তোলা।
বলে রাখা ভালো, প্রায় দুই দশক ধরে সেনাশাসনের ছত্রচ্ছায়ায় থাইল্যান্ড পরিচালিত হচ্ছে। গণতন্ত্র নেই বললেই চলে। ভেঙে পড়েছে বিচারব্যবস্থাও। রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে রাজ পরিবার, আমলা, সামরিক কর্মকর্তা ও বিচারকদের থলের ভেতর।
এই দমবন্ধ অবস্থারই পরিবর্তন চাইছেন তরুণেরা। তাই তাঁরা দলে দলে তরি ভিড়িয়েছেন মুভ ফরোয়ার্ডের কাছে। মুভ ফরোয়ার্ড হচ্ছে ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির উত্তরসূরি। আজ থেকে পাঁচ বছর আগে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক মঞ্চে আবির্ভাব ঘটে ফিউচার ফরোয়ার্ড পার্টির।
২০১৯ সালের নির্বাচনে তৃতীয় বৃহত্তম আসন জিতে রক্ষণশীলদের হতবাক করে দিয়েছিল ফিউচার ফরোয়ার্ড। তখন ভয় পেয়ে সামরিক কর্মকর্তা, সিনিয়র আমলা ও বিচারকেরা মিলে সাংবিধানিক আদালতের মাধ্যমে ফিউচার ফরোয়ার্ডের অনেক নেতাকে রাজনীতি থেকে নিষিদ্ধ করেন। এমন অবস্থায় দলটি সংসদে তার এমপিদের এক-তৃতীয়াংশ হারায়। ফলে ফিউচার ফরোয়ার্ডের স্থলাভিষিক্ত হয় মুভ ফরোয়ার্ড এবং সংসদে তারা একমাত্র বিরোধী কণ্ঠে পরিণত হয়।
ফিউচার ফরোয়ার্ডের মতো মুভ ফরোয়ার্ডকেও স্তব্ধ করতে চেয়েছিল থাইল্যান্ডের ক্ষমতাসীনেরা। কিন্তু কোনোভাবেই তাদের জনপ্রিয়তা কমাতে পারেননি তাঁরা। দেশের মানুষ মনে করে, থাইল্যান্ডের পরিবর্তনের জিয়নকাঠি মুভ ফরোয়ার্ডের হাতেই রয়েছে। এর প্রতিফলনও দেখা গেল গতকালের ভোটে।
২০১৪ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানে থাইল্যান্ডে তৎকালীন নির্বাচিত সরকার উৎখাত হয়। এরপর গতকাল রোববারের নির্বাচনে প্রথমবারের মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা করল মুভ ফরোয়ার্ড। প্রাথমিক ফলাফল অনুযায়ী, ৫০ লাখ ভোট পেয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে এগিয়ে আছে মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি (এমএফপি)। বলা বাহুল্য, মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির এই বিস্ময়কর উত্থানের পেছনে রয়েছে দেশটির তরুণেরা।
থাই ভাষায় ‘তা সাওয়াং’ একটি বিশেষ শব্দ। এর অর্থ হচ্ছে, রাজতন্ত্র সম্পর্কে চোখ খুলে যাওয়া। অর্থাৎ রুকচানোক শ্রীনর্ক বোঝাতে চাইছেন, তাঁর চোখ খুলে গেছে।
এভাবে অনেক তরুণের চোখ খুলে গেছে থাইল্যান্ডে। তাঁরা দলে দলে জড়ো হয়েছেন মুভ ফরোয়ার্ডের পেছনে। বছর তিনেক আগেও অবশ্য এতটা জনপ্রিয়তা ছিল না মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির। কিন্তু ধীরে ধীরে তারা যেসব এজেন্ডা নির্ধারণ করেছে এবং থাই রাজতন্ত্র সংস্কারের জন্য আন্দোলনের ডাক দিয়েছে, তা দিন শেষে বিপুলসংখ্যক মানুষকে আকৃষ্ট করেছে।
চন্টিচা জাংগ্রু নামের এক তরুণ শুনিয়েছেন তাঁর চোখ খুলে যাওয়ার গল্প। তিনি বলেন, ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানের আগেই তাঁর চোখ খুলে গেছে। তাই তিনি ২০১৪ সালে অভ্যুত্থানের বিরোধিতা করেছিলেন। ২০২০ সালে যখন রাজতন্ত্রবিরোধী বিক্ষোভ হয়, সেই বিক্ষোভেও তাঁর ছিল সক্রিয় অংশগ্রহণ। এখন তিনি পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার চেষ্টা করছেন। (নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন চন্টিচা। শেষ পর্যন্ত ভোটে জয়ী হয়েছেন কি না, তা এখনো জানা যায়নি।)
নির্বাচনের কয়েক দিন আগে চন্টিচা জাংগ্রু বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ২৮টি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে দুটি মামলার রায়ে আমার ১৫ বছরের কারাদণ্ডও হয়েছে। তারপরও আমি থামব না। দেশের পরিবর্তনের জন্য কথা বলবই।’
থাই তরুণদের এ সাহসী ভূমিকা বয়স্ক ভোটারদেরও মুগ্ধ করেছে। অনেক প্রবীণ বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরাও পরিবর্তন চান এবং তাঁরা বিশ্বাস করেন, এই তরুণেরা তাঁদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবেন।
থিতিনান পংসুধিরাক নামের একজন থাই নাগরিক বলেছেন, মুভ ফরোয়ার্ডের এজেন্ডাগুলো সেনাবাহিনী, রাজতন্ত্র, বিচার বিভাগ ও ক্ষমতা কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করে। আর এই এজেন্ডাগুলোই তরুণ-যুবাদের আকৃষ্ট করেছে।
সূত্র: বিবিসি, এএফপি ও আল-জাজিরা