হোম > বিশ্লেষণ

লবিং ফার্ম কী, সবাই যুক্তরাষ্ট্রে কেন লবিস্ট নিয়োগ করে

আজকের পত্রিকা ডেস্ক­

প্রতীকী ছবি

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে পশ্চিমা বিশ্বে লবিস্ট নিয়োগের ঘটনা নতুন নয়। বিশেষ করে বিশ্বের অন্য দেশগুলো নিজ স্বার্থ উদ্ধারে মার্কিন প্রশাসনকে প্রভাবিত করতে প্রায়ই লবিং ফার্ম নিয়োগ দেয়। সাম্প্রতিক সময়ে খবর এসেছে, বাংলাদেশের দুই প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারত ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের প্রচেষ্টায় বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয়ে লবিং ফার্ম নিয়োগ দিয়েছে।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য প্রিন্টের খবরে বলা হয়েছে, চলতি আগস্টের শুরুতে ওয়াশিংটনে ভারতীয় দূতাবাস একটি লবিং ফার্মের সঙ্গে চুক্তি করেছে। তিন মাসের এই চুক্তিতে ভারতকে প্রতি মাসে ৭৫ হাজার ডলার করে ফি দিতে হবে। মারকিউরি পাবলিক অ্যাফেয়ার্স নামের এই লবিং ফার্মে এক সময় কো-চেয়ার ছিলেন সুজি ওয়াইলস। তিনি বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের চিফ অব স্টাফ।

গত জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি প্রভাবশালী মার্কিন লবিং প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয় মিয়ানমারের জান্তা সরকার। এই প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক ফি ৩০ লাখ মার্কিন ডলার বা ৩৬৫ কোটি টাকা। চুক্তির মেয়াদ মিয়ানমারে আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় জাতীয় নির্বাচনের আগপর্যন্ত।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে আইন ও নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়া বেশ জটিল। এখানে ব্যবসায়িক স্বার্থ, নাগরিক অধিকার, পেশাজীবী সংগঠন, এনজিও কিংবা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক—সবই জড়িত। এসব ক্ষেত্রে সরকার ও নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে অপর পক্ষের হয়ে যে পেশাদার সংস্থাগুলো কাজ করে, সেগুলোই হলো লবিং ফার্ম।

সহজভাবে বললে, লবিং ফার্ম এমন প্রতিষ্ঠান, যাদের কাজই হলো মক্কেলের হয়ে তদবির করা। তারা ক্লায়েন্টদের পক্ষে সরকার, সংসদ সদস্য বা নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে প্রভাবিত করে। এই ক্লায়েন্টরা হতে পারে বড় কোনো কোম্পানি, বাণিজ্য সংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, নাগরিক অধিকার সংগঠন, এমনকি বিদেশি সরকারও। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা গণতন্ত্রগুলোতে এটি বড় শিল্পে পরিণত হয়েছে।

লবিং ফার্ম কীভাবে কাজ করে

প্রথমত, তারা আইন প্রণয়ন ও নীতির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। উদাহরণ হিসেবে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি যদি গবেষণা ও উদ্ভাবনের জন্য কর ছাড় চায়, তবে তারা লবিস্টের শরণাপন্ন হয়। লবিস্টেরা বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের আইনপ্রণেতাদের কাছে সেই প্রস্তাব পেশ করেন। অনেক সময় আইন প্রণয়নের খসড়া বা সংশোধনী তৈরিতেও তাদের ভূমিকা থাকে।

দ্বিতীয়ত, তারা নীতিনির্ধারকদের তথ্য ও গবেষণা সরবরাহ করে থাকে। ধরা যাক, মার্কিন কংগ্রেসে নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে আলোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে লবিং ফার্ম সংশ্লিষ্ট গবেষণা, পরিসংখ্যান এবং বিদেশি অভিজ্ঞতার তথ্য সংগ্রহ করে উপস্থাপন করতে পারে। এতে নীতিনির্ধারকেরা আরও পরিপূর্ণ ধারণা পান।

তৃতীয়ত, লবিং কেবল রাজনীতিবিদদের কক্ষে সীমাবদ্ধ নয়। এর দুটি ধারা আছে—ইনসাইড লবিং ও আউটসাইড বা গ্রাসরুটস লবিং। ইনসাইড লবিং মানে সরাসরি বৈঠক, ফোনকল বা ই-মেইলের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের প্রভাবিত করা। অন্যদিকে আউটসাইড লবিং হলো জনমত তৈরি করা—যেমন সংবাদপত্রে প্রচার চালানো, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্যাম্পেইন করা বা সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা। এতে সরকারের ওপর চাপ বাড়ে।

চতুর্থত, লবিং ফার্মগুলো আইন পর্যবেক্ষণ-পর্যালোচনার কাজও করে। নতুন কোনো বিল আসছে, যা শিল্প খাতের কোনো ক্ষতি করতে পারে—এমন খবর জানলেই লবিং ফার্ম ক্লায়েন্টকে সতর্ক করে এবং কীভাবে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া যায় তার পরামর্শ দেয়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির ইতিহাস পাঠ করলেই বোঝা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে লবিংয়ের বিষয়টি যতটা আলোচিত অন্যান্য দেশে ততটা নয়। যুক্তরাষ্ট্রে লবিং অনেক সমালোচিত হলেও এর বৈধতা রয়েছে। মার্কিন সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতেই বলা হয়েছে নাগরিকেরা সরকারের কাছে অভিযোগ জানাতে ও নিজেদের দাবি উপস্থাপন করতে পারবেন। এই সাংবিধানিক অধিকার থেকেই লবিংয়ের ভিত্তি তৈরি হয়েছে।

শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্টদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে লবিং ডিসক্লোজার অ্যাক্ট-১৯৯৫। এই আইনে বলা হয়েছে, যিনি পেশাদার লবিস্ট, তাঁকে নিবন্ধন করতে হবে এবং প্রতি তিন মাসে তাঁর খরচ, কাজের ক্ষেত্র ও ক্লায়েন্টের নাম প্রকাশ করতে হবে। পরে অনেস্ট লিডারশিপ অ্যান্ড ওপেন গভর্নমেন্ট অ্যাক্ট-২০০৭ এ আরও কড়া নিয়ম চালু করা হয়। এতে স্বচ্ছতা বেড়েছে এবং জনসাধারণ জানতে পারছে কোন কোম্পানি বা সংগঠন কোন নীতি প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে।

লবিংয়ের ইতিবাচক দিক

১. কণ্ঠস্বর তুলে ধরা: সাধারণ মানুষ সরাসরি আইনপ্রণেতাদের কাছে যেতে পারে না। কিন্তু তাদের সংগঠন বা ইউনিয়ন লবিং ফার্মের মাধ্যমে দাবি জানাতে পারে।

২. তথ্য সরবরাহ করা: রাষ্ট্রীয় যেকোনো নীতি, তা কৃষি বা প্রযুক্তি যেটাই হোক—এসব জটিল ক্ষেত্রের সঠিক তথ্য দিয়ে নীতিনির্ধারকদের সহায়তা করে তারা।

৩. বহুমুখী স্বার্থের প্রতিফলন: লবিং গোষ্ঠীর মাধ্যমে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মতামত নীতি প্রণয়নে প্রতিফলিত হয়, যা গণতান্ত্রিক ভারসাম্য তৈরি করে।

লবিং বৈধ, তবে সমালোচনাও কম নয়। অনেকেই বলেন, অর্থশক্তি যার হাতে বেশি, তার লবিং প্রভাবও তত বেশি। এতে বড় করপোরেশনের কণ্ঠস্বর নীতিনির্ধারণে প্রাধান্য পায়, অথচ সাধারণ মানুষের সমস্যা পেছনে পড়ে যায়। আবার কখনো কখনো লবিংকে ‘বৈধ দুর্নীতি’ বলা হয়, কারণ এটি টাকার বিনিময়ে নীতি প্রভাবিত করে।

এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে ধরা যেতে পারে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তরফ থেকে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য লবিং ফার্ম নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টিকে। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফরেন এজেন্টস রেজিস্ট্রেশন অ্যাক্ট’ অনুযায়ী জমা দেওয়া নথিতে দেখা গেছে, মিয়ানমারের জান্তা সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় ও ওয়াশিংটনভিত্তিক ডিসিআই গ্রুপ নামের এই মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানটি জান্তার জন্য ওয়াশিংটনে ‘জনসংযোগ কার্যক্রম’ পরিচালনা করবে এবং বাণিজ্য, প্রাকৃতিক সম্পদ ও মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্গঠনের চেষ্টা করবে।

এ ছাড়া এআইপিএসি বা আইপ্যাক অর্থাৎ আমেরিকান ইসরায়েল পাবলিক অ্যাফেয়ার্স কমিটি নামের দ্বিদলীয় ইসরায়েল-পন্থী লবি গ্রুপটি সবার চেয়ে ব্যতিক্রম। তারা মার্কিন সরকারের আইনসভা ও নির্বাহী শাখায় ইসরায়েল-পন্থী নীতিগুলোর পক্ষে সমর্থন আদায় করে। মধ্যপ্রাচ্যের নীতিকে প্রভাবিত করতে এআইপিএসি লবিং কার্যক্রম এবং বিভিন্ন থিংক ট্যাংকে অর্থায়ন করে। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এই কাজ করছে। কিন্তু তারা নিবন্ধিত নয়। ফলে আইনি বাধ্যবাধকতার মধ্যে পড়তে হয় না।

লবিং ফার্মের সমর্থকদের যুক্তি হলো, লবিং না থাকলে নীতিনির্ধারকেরা প্রয়োজনীয় তথ্যই পেতেন না। তাঁরা বলেন, আইন মেনে এবং স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হলে লবিং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করে, দুর্বল নয়।

যাই হোক, লবিং ফার্ম মূলত সরকারের নীতি ও আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার পেশাদার প্রতিষ্ঠান। তারা সরাসরি বৈঠক করে, গবেষণা উপস্থাপন করে, গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার কৌশল প্রণয়ন করে এবং ক্লায়েন্টদের স্বার্থ রক্ষায় সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করে। সমালোচনা থাকলেও লবিং আজকের বিশ্বে এক গুরুত্বপূর্ণ শিল্প, যা নীতি প্রণয়নের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছে প্রতিদিন।

আরও খবর পড়ুন:

পুতিন জানেন—ইউক্রেনের ‘সময় ফুরিয়ে আসছে’, যুদ্ধ শেষের তাড়া নেই

দোনেৎস্ক: শান্তি-আলোচনার টেবিলে পুতিন-জেলেনস্কির অন্তিম বাধা, এর গুরুত্ব কতটা

কী হবে, যদি বিলিয়নিয়ারদের সম্পদ কেড়ে নেওয়া হয়

জাপানের ‘লৌহমানবী’ কি দেশকে চীনের সঙ্গে যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন

পুতিন-মোদির আসন্ন বৈঠকের মূলে কী আছে

শাহেনশাহ-ই-পাকিস্তান: আসিম মুনিরের সর্বেসর্বা হয়ে ওঠার স্বপ্ন কি তাসের ঘর

যে ইমরান খানকে আমি চিনতাম—শশী থারুরের স্মৃতিকথায় আশঙ্কা

যুক্তরাষ্ট্র-ভেনেজুয়েলার উত্তেজনায় রাশিয়া ও চীন কেন নীরব

দুবাইয়ে তেজস দুর্ঘটনা: সামনে আসছে ভারতের যুদ্ধবিমান কর্মসূচির পুরোনো দুর্বলতা

হাসিনার ভাগ্যে কী আছে