ডি ডব্লিউর প্রতিবেদন
দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতির অন্যতম সংবেদনশীল এলাকা হিসেবে পরিচিত ভারতের শিলিগুড়ি করিডর। মাত্র ২২ কিলোমিটার চওড়া ভূখণ্ডটি চিকেন’স নেক নামেও পরিচিত। এই করিডর দিয়েই মূল ভারতের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাত রাজ্য—অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মণিপুর, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, সিকিম ও ত্রিপুরা। একদিকে নেপাল-ভুটান, আরেক দিকে বাংলাদেশ ও চীন ঘেরা এই অঞ্চল দীর্ঘদিন ধরে ভারতের কৌশলগত দুর্বলতার কেন্দ্রবিন্দু।
সম্প্রতি একাধিক ভারতীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশটির সেনাবাহিনী শিলিগুড়ি করিডরের চারপাশে তিনটি নতুন পূর্ণাঙ্গ গ্যারিসন (সক্রিয় সেনাঘাঁটি) স্থাপন করেছে এবং সীমান্ত এলাকায় বড় ধরনের সেনাসমাবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে।
ডি ডব্লিউ বাংলার সীমান্তবিষয়ক প্রতিবেদক স্যমন্তক ঘোষ জানিয়েছেন, এ বিষয়ে ভারতীয় সেনা বা সরকারি সংস্থাগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না বললেও বিস্তৃত বাহিনী মোতায়েন, নতুন স্থাপনা ও টহল বৃদ্ধি স্পষ্ট চোখে পড়ছে।
এই বাড়তি সামরিক উপস্থিতি এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন ২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ইতিহাসের অন্যতম নিম্নতম পর্যায়ে নেমে এসেছে।
এর মধ্যে আজ সোমবার বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেছেন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর থেকে সেখানেই আছেন তিনি।
রায় ঘোষণার পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সাংবাদিকদের বলেছেন, মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ভারতকে আবারও চিঠি দেবে বাংলাদেশ সরকার।
তবে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে হাসিনাকে দেশে ফেরাতে ‘প্রত্যর্পণ চুক্তি’ কার্যকর করার প্রস্তুতি দেখা গেলেও ভারতের আনুষ্ঠানিক অবস্থান এখনো স্পষ্ট নয়। এই বিষয়ও দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকা শেখ হাসিনা ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ককে তুলনামূলক স্থিতিশীল রেখেছিলেন। তবে তাঁর ভারতে আশ্রয় নেওয়া এবং তারপরের ঘটনাবলি দুই দেশের সম্পর্কে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি করেছে। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে চলছে। এই সরকার ভারতকে আগের মতো ঘনিষ্ঠভাবে দেখছে না—এমন ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।
নয়াদিল্লির থিংকট্যাংক অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান হর্ষ ভি. পন্ত ডি ডব্লিউকে বলেন, ‘শিলিগুড়ি করিডর ভারতের একটি কৌশলগত দুর্বলতা, যাকে সুরক্ষিত রাখা অপরিহার্য।’
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বাড়তে থাকা ভারতবিরোধী মনোভাব এবং ড. ইউনূস সরকারের ভারতবিরোধী অবস্থানের ইঙ্গিত—উভয়ই নয়াদিল্লিকে সতর্ক করেছে।
নতুন গ্যারিসন স্থাপনের খবরের পাশাপাশি, ভারতীয় বিমানবাহিনী ৯ নভেম্বর আসামে ইতিহাসের অন্যতম বৃহৎ এয়ার শো প্রদর্শন করে। এরপর ১৩ থেকে ২০ নভেম্বর উত্তর-পূর্বাঞ্চলে সাত দিনব্যাপী বড়সড় মহড়া চালায়।
এই সামরিক কর্মকাণ্ডগুলো এমন সময় হচ্ছে, যখন প্রথমবারের মতো ১৯৭১ সালের পর পাকিস্তানের একটি যুদ্ধজাহাজ বাংলাদেশে নোঙর করেছে এবং পাকিস্তানের নৌবাহিনীর প্রধান ঢাকা সফর করেছেন।
হর্ষ ভি. পন্ত বলেন, ভারত নিয়মিত সামরিক মহড়ার মাধ্যমে জানিয়ে দিচ্ছে, তারা আঞ্চলিক চ্যালেঞ্জ সম্পর্কে সচেতন। তবে তাঁর মতে, এয়ার শো বিশেষভাবে কারও বিরুদ্ধে শক্তি প্রদর্শন ছিল না।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক লেফটেন্যান্ট জেনারেল উৎপল ভট্টাচার্য ডি ডব্লিউকে বলেন, ‘কখনো এগুলো নিয়মিত মহড়া, কখনো বার্তা দেওয়ার কৌশল। পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যেতে পারে—আজকের বন্ধু আগামীকাল শত্রুও হতে পারে।’
হর্ষ ভি. পন্ত মনে করেন, ভারতের সামরিক পদক্ষেপগুলো প্রতিরক্ষামূলক হলে উত্তেজনা আরও বাড়তে পারে; বিশেষ করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের ‘উসকানিমূলক’ বক্তব্য যদি অব্যাহত থাকে।
তিনি ড. ইউনূসের করা একটি মন্তব্যের কথা উল্লেখ করেন। চলতি বছরের মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. ইউনূস এমন একটি মন্তব্য করেছিলেন। যদিও ঢাকা এই মন্তব্যের উদ্দেশ্য আঞ্চলিক সংযোগের সম্ভাবনা তুলে ধরা বলে দাবি করেছে, তবে ওই এলাকার ভূরাজনৈতিক সংবেদনশীলতার কারণে নয়াদিল্লি এই মন্তব্যকে ভালোভাবে নেয়নি।
ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল স্থলবেষ্টিত (ল্যান্ডলকড), আর তাদের সাগরে প্রবেশের একমাত্র প্রবেশদ্বার বাংলাদেশ।’ ভারতের কাছে বিষয়টি অস্বস্তিকর ছিল।
উভয় দেশের সরকারই সামরিক উপস্থিতি বৃদ্ধির বিষয়ে নীরব রয়েছে এবং ডি ডব্লিউর মন্তব্যের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেছে।
ডি ডব্লিউ বলছে, আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে ভারত সম্ভবত বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারকে অপেক্ষা করাচ্ছে। অর্থাৎ ‘নির্বাচিত সরকার এলেই পূর্ণমাত্রায় সম্পর্ক পুনর্গঠিত হবে।’
২০২৪ সালের আগস্টে শেখ হাসিনার পতনের পর থেকে মূলত সম্পর্ক খারাপের দিকে যেতে থাকে। তবে এরপরও কিছু বিষয়ে আড়ালে অবিশ্বাস থেকে যায়।
২০১৯ সালের ভারতের নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) বাংলাদেশে তীব্র নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের কথায় ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ শব্দের ব্যবহার বৈরিতা বাড়ায়। আর শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়া এই বিরোধকে আরও গভীর করে তোলে।
ঢাকা বারবার তাঁকে ফেরত চাইলেও ভারত নীরব থেকেছে। এ ছাড়া ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে শেখ হাসিনার উপস্থিতি ঢাকার কাছে উসকানি হিসেবে দেখা হচ্ছে। গত ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে এ বিষয়ে উদ্বেগ জানায়।
বাংলাদেশের সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির ডি ডব্লিউকে বলেন, ‘১৫ বছর ধরে ভারত ভেবেছে, ঢাকা তাদের নিয়ন্ত্রণে আছে—এ যুগ শেষ। তবে ক্ষুদ্র দেশগুলোর ওপর ভারতের প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা আরও বেড়েছে।’
ভারত-বাংলাদেশ উত্তেজনার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের সম্পর্কেও নতুন উষ্ণতা দেখা যাচ্ছে। অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ প্রোগ্রামের প্রধান হর্ষ ভি. পন্ত একে বলেছেন ‘নতুন প্রেম’।
১৯৭১ সালে যে পাকিস্তান থেকে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে, সেই পাকিস্তান এখন ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে সক্রিয়। সম্প্রতি ইসলামাবাদ ঢাকায় পররাষ্ট্র এবং গোয়েন্দা প্রধানসহ উচ্চপদস্থ প্রতিনিধিদল পাঠিয়েছে, নতুন বাণিজ্য চুক্তি করেছে, সামরিক সহযোগিতা পুনরুজ্জীবিত করেছে, পাকিস্তানি নৌ জাহাজ বাংলাদেশের বন্দর পরিদর্শন করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ভারতের প্রভাব কাটাতে পাকিস্তানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছে, আর ভারত বিষয়টি নিরাপত্তার হুমকি হিসেবে দেখছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক জেনারেল ফজলে ইলাহী আকবর ডি ডব্লিউকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকাকে অবশ্যই স্বীকার করবে, কিন্তু নিজের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভারতকে খুশি করা অব্যাহত রাখবে না।’
সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ভিত্তি বোঝে, কিন্তু সম্পর্কের জন্য পারস্পরিক সম্মান, সমতা ও মর্যাদা প্রয়োজন; যা ভারতের আচরণে দেখা যাচ্ছে না।’
তবে চলমান উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভে অংশ নিতে ১৯ নভেম্বর নয়াদিল্লি সফর করছেন। সেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে। আজ শেখ হাসিনার রায়ের পর এই সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
বাংলাদেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সাবেক জেনারেল ফজলে ইলাহী আকবর ডি ডব্লিউকে বলেন, ‘বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে ভারতের ভূমিকাকে অবশ্যই স্বীকার করবে, কিন্তু নিজের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হলে ভারতকে খুশি করা অব্যাহত রাখবে না।’
সাবেক কূটনীতিক এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ভিত্তি বোঝে, কিন্তু সম্পর্কের জন্য পারস্পরিক সম্মান, সমতা ও মর্যাদা প্রয়োজন; যা ভারতের আচরণে দেখা যাচ্ছে না।’
তবে চলমান উত্তেজনার মধ্যে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান কলম্বো সিকিউরিটি কনক্লেভে অংশ নিতে ১৯ নভেম্বর নয়াদিল্লি সফর করছেন। সেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সঙ্গে তাঁর বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে। আজ শেখ হাসিনার রায়ের পর এই সফর বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।