যুক্তরাষ্ট্র এখনো নিজেদের ‘মুক্ত বিশ্বের নেতা’ বলে দাবি করতেই পারে। কিন্তু ২০২২ সালের জুলাইয়ে প্রকাশিত উন্নয়ন সূচকে দেশটির অবস্থান সেই কথা বলে না। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্টের মতে, সার্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র ‘ত্রুটিপূর্ণ গণতন্ত্রের’ দেশ বলে বিবেচিত হতে পারে। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে গণতন্ত্র এবং অসমতার সূচকে উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় খুব একটি এগিয়ে রাখা যাচ্ছে না।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন সূচকে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান ৯ ধাপ নেমে বর্তমানে বিশ্বে ৪১তম। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার ১৭টি লক্ষ্য–যার বেশির ভাগই পরিবেশ এবং সমতা বিষয়ে–বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান কিউবা ও বুলগেরিয়ার মাঝে। এই দুটি দেশই উন্নয়নশীল দেশ বলে বিবেচিত।
কেন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিম্নগামী অবস্থান সেই বিষয়ে মেরিল্যান্ডের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারার ক্যাথলিন ফ্রিডল বলেন, ‘আমরা যারা যুক্তরাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন নিয়ে গবেষণা করি তাঁরা জানি যে, এই ক্রমাবনতিশীল সূচকগুলো মূলত দুটি অনিবার্য সমস্যার পরিণতি। প্রথমটি হলো বর্ণবাদ, যা মার্কিনিদের মূল অনেক সমস্যা যেমন স্বাস্থ্য সেবা, শিক্ষা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা এবং পরিবেশের সুরক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ছাপিয়ে গেছে। একই সময়ে মার্কিন গণতন্ত্রের জন্য গুরুতর সমস্যা হিসেবে হাজির হয়েছে “মার্কিন কৈবল্য” বা যুক্তরাষ্ট্র অন্যদের চেয়ে আলাদা মনোভাব। যা ক্রমশ গুরুত্ব লাভ করেছে এবং ভুল সংশোধনের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।’ রুদ্ধ পথ আবার কখনো নতুন করে শুরু হবে কিনা সেই বিষয়টি এখনো অস্পষ্ট। কারণ, বিশ্বজুড়েই গণতন্ত্রের চর্চা নিম্নগামী।
টেকসই উন্নয়ন সূচক বৈশ্বিক অন্যান্য সূচকের চেয়ে আলাদা। এই সূচক সাধারণ মানুষের বিভিন্ন সক্ষমতা, বিশেষ করে তাদের কিছু উপভোগ করার সক্ষমতা, পরিষ্কার বাতাস–পানি এবং সম্পদ আহরণের সক্ষমতার দিকে গভীর মনোযোগ দেয়। তাই এই সূচক দানবীয় মার্কিন অর্থনীতিকে আমলে নেওয়ার সময় সম্পদ অর্জনেরে ক্ষেত্রে সকলের সমান সুযোগ না পাওয়ার বিষয়টিও সামনে চলে আসে। বৈশ্বিক আয় বৈষম্যের সূচক ‘গিনি সহগ’ অনুসারেও বিগত ৩০ বছর ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে আয় বৈষম্য বাড়ছে।
এসডিজি সূচক অনুসারে যুক্তরাষ্ট্র গুণগত শিক্ষা এবং লিঙ্গ সমতা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে যথেষ্ট চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে। চ্যালেঞ্জ রয়েছে শান্তি, ন্যায় বিচার এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠনের ক্ষেত্রেও। গুণগত শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করলেও লিঙ্গ সমতা ও শান্তি, ন্যায় বিচার এবং শক্তিশালী গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান গঠন–লক্ষ্যমাত্রার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ স্থবির অবস্থায় রয়েছে।
ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের ‘গণতন্ত্র সূচক’ বিষয়ক এক নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০২১ সালে গণতন্ত্র সূচকে প্রায় সব দেশই কমবেশি পয়েন্ট হারিয়েছে। সোজা কথায় বিশ্বে গণতন্ত্রের চর্চা কমেছে। ২০২১ সালে বিশ্বের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ মানুষ কর্তৃত্ববাদী শাসনের অধীন ছিল। এই সময়ে পূর্ণ গণতন্ত্র ভোগ করে মাত্র ৬ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ। এ থেকে সহজেই অনুমেয়, বিশ্বে গণতন্ত্রের অবস্থান কোথায়।
কোভিড মহামারিতে বিশ্বজুড়ে সাধারণ জনগণের অনেক গণতান্ত্রিক অধিকার বাতিল করা হয় জনস্বাস্থ্য রক্ষার দোহাই দিয়ে। কোভিড শেষের দিকে থাকলেও সেসব বিধিনিষেধের অনেকগুলোই এখনো ওঠানো হয়নি। জনগণকে জোর করে ভ্যাকসিন নিতে বাধ্য করার মতো ঘটনাও ঘটেছে। আবার তার প্রতিবাদে প্রতিবাদ–সমাবেশও দেখেছি বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। সেগুলোকে অনেকটাই শক্ত হাতে দমন করা হয়েছে। কানাডায় ট্রাক ড্রাইভারদের আন্দোলন দমন করা হয়েছে অনেকটা বল প্রয়োগের মাধ্যমে। সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের বড় যে গুণ–সহিষ্ণুতা–তার অভাব দেখা গেছে বিশ্বের প্রায় সব প্রান্তেই।
যা হোক, গণতন্ত্রের অবস্থান কী হবে আগামী বিশ্বে তা সময়ই নির্ধারণ করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র যে আগের অবস্থানে নেই তা অনেকটাই স্পষ্ট। গণতন্ত্রের অবনমনের কালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং উদীয়মান সামরিক শক্তি হিসেবে চীনের উত্থান এবং ইউরোপের দোরগোড়ায় রাশিয়ার সশস্ত্র অবস্থান এবং দেশ দুটোর রাজনৈতিক মতাদর্শ গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিতে পারে। এবং তা গণতন্ত্রের নিম্নগামী যাত্রাকে আরও দ্রুততর করতে পারে।
তথ্যসূত্র: দ্য কনভারসেশন, দ্য ইকোনমিস্ট, সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স