মানুষ জীবন ধারণের জন্য যা কিছু গ্রহণ করে, তার সিংহভাগই আসে প্রকৃতি থেকে। প্রকৃতির প্রতিটি প্রাণের আছে আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে পশু-পাখি ও মানুষের সঙ্গে প্রতিটি গাছের ভাষা ও আচরণ আলাদা। গাছের কাছে না গেলে সেই ভাষা বোঝা যায় না।
সনাতন মালো উল্লাস। প্রকৃতিকে ভালোবাসেন মনপ্রাণ উজাড় করে। ভালোবাসার সেই জায়গা থেকে রাস্তাঘাটে পড়ে থাকা অপ্রয়োজনীয়, মূল্যহীন নানা উপকরণ দিয়ে তৈরি করেন বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম।
রাস্তাঘাটে নিতান্তই অবহেলায় পড়ে থাকা উপকরণ দিয়ে ভাস্কর্য তৈরির প্রসঙ্গে সনাতন বলেন, ‘শিল্পকর্ম, চিন্তা, চর্চা, সাধনা বা সংরক্ষণ এক সূত্রে গাঁথা। এ ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা মূল বিষয় বলে মনে হয় না আমার কাছে। আগ্রহ বা ভালোবাসা থাকলে যেকোনো জায়গা থেকে মানুষ অনেক কিছু তৈরি করতে পারে। আমার কাজের মূল উপাদান রাস্তাঘাটে, মাঠে, জঙ্গলে, পুকুরপাড়ে, নদীর ধারে পড়ে থাকা গাছের শেকড়, ভাঙা ডালপালা, লতাপাতা ও পশু-পাখির হাড়গোড়। ভাস্কর্য নিয়ে আমার কাজ করা ভালো লাগার জায়গা থেকে। এই ভালো লাগাটা ক্রমাগত ভালোবাসায় পরিবর্তিত হচ্ছে। তবে এই ভালোবাসাকে যত্ন ও পরিচর্যায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আন্তরিকতার। সেই আন্তরিকতার গভীরে আছে মানবিক সমাজ গঠনে নিজেকে নিবেদন করা।’
এ ধরনের শিল্পকর্মের দিকে সনাতনের আকর্ষণ কিন্তু ছোটবেলা থেকেই। বলা যায়, বেড়ে ওঠার সঙ্গেই কাঠ খোদাইয়ের বিষয়টি জড়িয়ে রয়েছে। সনাতন বলছেন, ‘তখন আমি বড়জোর তৃতীয় কিংবা চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। বাড়িতে প্রায় প্রতিবছর বর্ষাকালের শুরু কিংবা শীতের শেষে চার-পাঁচজনের একদল কাঠমিস্ত্রি আসতেন। তাঁরা মাসাধিককাল কিংবা তারও বেশি সময় ধরে নতুন নৌকা বানানো, পুরোনো নৌকা মেরামতের পাশাপাশি কাঠের নানা আসবাব তৈরি করতেন। বাড়ির খুব কাছেই ছিল কুমার নদ। তাঁরা নদের পাড়ে নৌকার বাদাম টানিয়ে ছায়াময় জায়গা তৈরি করে সেখানে কাজ করতেন সকাল থেকে রাত অবধি। স্কুল থেকে ফিরে প্রায় সারা দিনই কাটত সেই মিস্ত্রিদের সঙ্গে। হাতুড়ি, বাটাল, বাইসখান, রেন্দা, করাত, শীল ইত্যাদি হাতিয়ারের আলাদা আলাদা শব্দ আমাকে খুব টানত। কখনো কখনো টুকরো কাঠের ওপর হাতুড়ি ও বাটাল নিয়ে কিছু একটা করার প্রাণান্তকর চেষ্টা করতাম। বলতে গেলে শুরুর প্রথমটা সেখান থেকেই।’
২০০৫ সালে তিনি ঢাকায় স্থায়ীভাবে বাস করতে শুরু করেন। ছাত্রজীবন শেষে ঢোকেন বেসরকারি চাকরিতে। এর মধ্যে তিনি সময় ও সুযোগ বের করে তাঁর কাজ করার উপাদান সংগ্রহ করতেন। কাজের প্রয়োজনে ঢাকার বাইরে গেলে সেখান থেকে তিনি নিয়ে আসতেন গাছের টুকরো বা শেকড়সহ বিভিন্ন উপকরণ। এ ছাড়া পুরানা পল্টনের মুক্তি ভবনের বেসমেন্টে তাঁর কাজের জন্য একটা রুম ছিল। সেখানে তিনি তাঁর কাজগুলো সংরক্ষণে রাখতেন। ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলামের তাণ্ডবে হাজারো মানুষের অনেক মূল্যবান জিনিসের সঙ্গে তাঁর কাজগুলোও আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এ ঘটনার পরে ক্ষোভে অনেক দিন তিনি কাজ থেকে দূরে ছিলেন।
বর্তমানে কাজের পরিবেশ বা পরিধির বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘সীমিত আয়ের চাকরি করে ভাস্কর্যের মতো বিরাট বিষয়ে চর্চা করা দুঃসাহস ছাড়া আর কিছুই নয়। সংগ্রহে থাকা কিছু কাঠ আর শিকড় নিয়ে সাধারণ অ্যান্টিকাটার ও হাতুড়ি-বাটাল দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। এভাবে কাজ করা ভীষণ কষ্টকর ও সময়সাপেক্ষ। একদিকে বেঁচে থাকার সংগ্রাম, অন্যদিকে শিল্পচর্চা। নিজের জীবনের টানাপোড়েন মাঝেমধ্যে এই কাজে বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যদি টাকা-পয়সা উপার্জনের চাপ না থাকত, তবে নিজের মনের মতো করে তৈরি করতাম বিভিন্ন ধরনের শিল্পকর্ম। যদিও মাঝেমধ্যে মনে হয় এই উন্মাদনা নিতান্তই বিলাসিতা।’
সনাতনের করা এই ‘ব্যক্তিগত’ ও ‘আত্মিক’ পরিবারের উল্লেখ বেশ আগ্রহী করে তুলল। জানতে চাইলে বললেন, ‘আমি তিন রকম পরিবারের সদস্য। একটি নিজস্ব বা ব্যক্তিগত, একটি বৃহত্তর, আরেকটি আদর্শিক। ব্যক্তিগত পরিবার বলতে বৈবাহিক সূত্রে শিল্পী আক্তার আমার জীবনবন্ধু। আমাদের একটি কন্যাসন্তান আছে। তার নাম মেঘবতী স্লোগান। সে ৮ পেরিয়ে ৯-এর পথে। ক্লাস ওয়ানে পড়ে। আমরা বলি, “স্লোগান শিল্পী সনাতন—এক সত্তায় তিনজন”। মা-বাবা আছেন। আমার তিন বোন ও চার ভাই। এ ছাড়া দেশ ও দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মানবধর্মে বিশ্বাসী অগণিত আপনজন আমার আদর্শিক পরিবারের সদস্য।’
আলাপে পাখির প্রসঙ্গই ঘুরেফিরে আসে বারবার। নিজের স্বপ্ন ও কাজ যেন পাখির ডানাতেই ভর করে আছে। যেন সবুজই সনাতনের একমাত্র আরাধ্য। বললেন, ‘পৃথিবী ক্রমাগত পাখিশূন্য হয়ে যাচ্ছে। আমাদের এই প্রিয় শরীর খাঁচাটাও একদিন পাখিশূন্য হয়ে যাবে। যেদিন পৃথিবী থেকে শেষ পাখিটা বিলুপ্ত হবে, সেই দিন সেই পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে কি না, সে বিষয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি আমার কাজের মাধ্যমে একটা কথা বারবার বলতে চাই। সেটা হলো, মানুষের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে অবশ্যই পাখিদের বাসযোগ্য করতে হবে পৃথিবীকে।’