পুত্রহারা হয়েছেন শওকত ওসমান। রাজারবাগের মোমেনবাগে থাকতেন তিনি। শোকগ্রস্ত মানুষেরা যাচ্ছে তাঁর বাড়িতে। বাড়িটি তখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি। তিন-চারটা ঘর হয়েছে মাত্র। শওকত ওসমান সেই বাড়ির সামনে একটি চেয়ারে বসে আছেন। পাথরের মতো স্থির তিনি। ভেতরে ভেতরে কান্নায় ভেঙে পড়ছেন; কিন্তু বাইরে তা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু তাঁর লাল চোখই বুঝিয়ে দিচ্ছে–কখনো কখনো নিভৃতে কেঁদেছেন।
পাশের বাড়িটাই আবু জাফর শামসুদ্দীনের। বহুদিনের পুরোনো বন্ধু তাঁরা। আবু জাফর শামসুদ্দীন সেখানে আছেন। শওকত ওসমানের একটি হাত ধরে আছেন তিনি। আরও অনেকেই এসেছেন। দাফন করা হবে লাশ।
এ সময় সৈয়দ শামসুল হক আর শামসুর রাহমান সেখানে গিয়ে পৌঁছান। পাশে গিয়ে বসেন। ‘এই মৃত্যুর কি প্রয়োজন ছিল?’–এ কথা বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন শওকত ওসমান। এবং তা উচ্চারণ করতে থাকেন বারবার। হাহাকারে ছেয়ে যায় চারপাশ।
শওকত ওসমানের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন আবু জাফর শামসুদ্দীন আর বলতে থাকেন: ‘আহ্ শওকত, আহ্ শওকত!’
সময় কাটতে থাকে। একসময় চলে আসার সময় হয় সৈয়দ হক আর শামসুর রাহমানের। তখনই শওকত ওসমান বলে ওঠেন: ‘শামসুর রাহমান, দাঁড়াও, তুমি যে আঁদ্রে জিদের বইখানা চেয়েছিলে একদিন, এসেছো যখন নিয়ে যাও!’
এই অবিশ্বাস্য কথায় হতবাক হয়ে যান দুজন। শামসুর রাহমান নার্ভাস হয়ে গেলে বিড়বিড় করতে থাকেন। শুধু বলেন: ‘থাক না, থাক!’
উদ্ধার করেন সৈয়দ হক: ‘আরেকদিন আসব আমরা, বই নিয়ে যাব।’
শওকত ওসমান বলেন, ‘জীবনে শোক-দুঃখ থাকবেই, আসবেই; তাই বলে আমাদের সব কি থেমে থাকবে?’
সৈয়দ হক লিখেছেন: ‘সেই দিনটির কথা মনে পড়ে, সেই একটি দিনেই জীবনের মূল্যবান এই পাঠ তাঁর থেকে গ্রহণ করেছিলাম।’
সূত্র: সৈয়দ শামসুল হক, হৃৎকলমের টানে, পৃষ্ঠা: ৬৯