লেখকের সামাজিক অঙ্গীকার এবং অন্যদের সামাজিক অঙ্গীকারের চরিত্রের মধ্যে কোনো মৌলিক পার্থক্য বলে কিছু নেই। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত যেকোনো মানুষই সমাজের ওপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল। কাজেই সমাজের প্রতি প্রত্যেকেরই করণীয় আছে। সমাজ বলতে অবশ্য সবার জন্য একই জিনিস বোঝায় না। আমাদের শ্রেণিবিভক্ত সমাজে শোষক, শোষিত আছে, ধনী-দরিদ্র আছে। যে মানুষ যে শ্রেণিভুক্ত সে সেই শ্রেণির স্বার্থই রক্ষা করে। তার জন্য তার একধরনের অঙ্গীকার থাকে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে লেখক, শিল্পী, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ সবাই থাকেন। নিজের নিজের শ্রেণিবদ্ধ অবস্থায় তাঁদের সামাজিক দায়িত্ব, সামাজিক অঙ্গীকার থাকে। শোষকশ্রেণির প্রতিনিধি রাজনীতিবিদ, শিল্পী, সাহিত্যিক সবাই একই অঙ্গীকারে আবদ্ধ, যদিও তাঁদের কর্মক্ষেত্র ভিন্ন। একই ধরনের অঙ্গীকারের জন্য কর্মক্ষেত্রের ভিন্নতা সত্ত্বেও শোষক ও শোষিত শ্রেণির অঙ্গীকারবদ্ধ লোকদের নিজেদের কাজের মধ্যে স্বতন্ত্র একটা যোগসূত্র থাকে।
দুই শ্রেণির অঙ্গীকার সম্পর্কে মোটা দাগে বলতে গেলে বলতে হয়, শোষকশ্রেণির লোকদের অঙ্গীকার হচ্ছে, শোষণ-নির্যাতনমূলক সমাজব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা। এভাবে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে তারা সবাই কাজ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে বর্তমান বাংলাদেশের দক্ষিণ ও বাম বুর্জোয়া রাজনীতিবিদেরা যেমন এই শ্রেণিবিভক্ত সমাজ ও সাম্রাজ্যবাদের খেদমত করে, তাকে টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে, যারা এ ব্যবস্থা পরিবর্তন করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে কোনো রকম শত্রুতা করতে দ্বিধা করে না। ঠিক তেমনই এই শ্রেণির অসংখ্য দালাল বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, সাহিত্যিক বিভিন্ন ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মীও তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করে একই কাজ করে নিজ নিজ ক্ষেত্রে।
যারা এ সমাজ পরিবর্তন করতে চায় তারাও নিজেদের অঙ্গীকার অনুযায়ী রাজনীতি, শিল্প, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে কাজ করে। তাদের কাজের মধ্যেও একটা যোগসূত্র থাকে।
সূত্র: ‘দৈনিক বাংলা’ পত্রিকার পক্ষে বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১, বদরুদ্দীন উমরের ‘সাক্ষাৎকার সমগ্র’,
পৃষ্ঠা: ৪০-৪১।