সৃজনশীল সাহিত্যের বিকাশ স্থিতিশীল এবং অস্থিতিশীল উভয় ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশেই সম্ভব। গণতান্ত্রিক পরিবেশে যেমন সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব, তেমনি সেটা সম্ভব অগণতান্ত্রিক পরিবেশেও। ইংল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল থাকার সময় সেখানে শেক্সপিয়ার থেকে বার্নাড শ, চসার থেকে রোমান্টিক কবির দল, টমাস হার্ডি, সমারসেট মম বিভিন্ন মেজাজের শিল্পসাহিত্য সৃষ্টি করেছেন। আবার ফ্রান্স ও রাশিয়ায় সৃষ্টিশীল সাহিত্যের উজ্জ্বলতম উদাহরণ দেখা গেছে সেখানকার অস্থিতিশীল এবং অগণতান্ত্রিক পরিবেশে। আমাদের দেশেও স্থিতিশীল ও অস্থিতিশীল উভয় পরিবেশে প্রাচীন থেকে আধুনিক কাল পর্যন্ত সৃষ্টিশীল সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে।
কাজেই সৃজনশীল সাহিত্যের জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অথবা গণতান্ত্রিক পরিবেশ অপরিহার্য—এটা বলা চলে না, ইতিহাসেও তার কোনো সমর্থন নেই। তবে তার অর্থ এই নয় যে সাহিত্য সৃষ্টি ও চর্চার জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিষ্প্রয়োজন অথবা অপ্রাসঙ্গিক। মোটেই তা নয়। গণতান্ত্রিক ও স্থিতিশীল পরিবেশে জনগণ সাধারণভাবে শিল্প, সাহিত্যচর্চার সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি পেতে পারেন। সেই পরিবেশে সৃজনশীল সাহিত্য সৃষ্টির জন্য অপেক্ষাকৃত অনুকূল শর্তসমূহের আবির্ভাবও ঘটার কথা।
একই সঙ্গে রাজনীতির ক্ষেত্রে লেখকের ভূমিকা কী হবে, সেটা চিরকালের জন্য আগে থেকে নির্ধারিত হয়ে নেই। কারণ, এই ভূমিকা আসলে দেশের ও সমাজের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির ওপর নির্ভরশীল। যদি দেখা যায় যে সারা দেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের একটা তাগিদ প্রবলভাবে বিরাজ করছে এবং সেই পরিবর্তন ব্যতীত দেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে অচলাবস্থার নিরসন সম্ভব নয়, তাহলে সকল পর্যায়ের রাজনৈতিক কর্মীদের, রাজনৈতিক সংগঠকদের যেমন এ পরিবর্তনের জন্য অধিক মাত্রায় সক্রিয় হতে হয়, তেমনি লেখকদেরও সেভাবে সক্রিয় হতে হয় মূলত লেখনীর মাধ্যমে। এটাই তাঁদের লেখক হিসেবে ভূমিকা। প্রগতিশীল লেখকদের ভূমিকা।
অন্যদিকে প্রতিক্রিয়াশীল ধান্ধাবাজ লেখকদের ভূমিকা হলো সরাসরি অথবা কৌশলে পরিবর্তনের এই প্রক্রিয়াকে বাধা দেওয়ার জন্য নিজেদের লেখনী চালনা করা এবং নানা ধরনের কূটতত্ত্ব তৈরি করা।
তথ্যসূত্র: ‘দৈনিক বাংলা’র পক্ষ থেকে বদরুদ্দীন উমরের সাক্ষাৎকার গ্রহণ, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯১। সাক্ষাৎকার সংগ্রহ, পৃষ্ঠা: ৪১-৪২।