১৯০৫ সালে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নিয়ে গঠিত নতুন প্রদেশের রাজধানী হলো ঢাকা। প্রশাসনিক কারণে তখন প্রয়োজন অনেক অনেক নতুন দালানকোঠা। নতুন সেসব কাঠামো নির্মাণের জন্য ইংরেজ সরকার বেছে নিল মূল শহরের উত্তরে রমনার খোলা প্রান্তরকে। একটি-দুটি করে গড়ে উঠতে শুরু করল ইংরেজ আমলাদের বসবাসের জন্য দোতলা সব বাড়ি। ঢালু ছাদের লাল রঙের বাড়িগুলো অনেকটা বিলেতি কটেজের মতো। কিন্তু বাড়িগুলোর আশপাশের পথঘাট তখনো সুবিন্যস্ত হয়নি। রমনার এই শহরতলিকে কার্যকর ও নান্দনিক নগরের রূপ দেওয়ার উদ্যোগ নিলেন নতুন গভর্নর হেয়ার। তাঁর অনুরোধে ১৯০৯ সালের জুলাই মাসে পূর্ববঙ্গের উদ্যানতাত্ত্বিক উপদেষ্টা হিসেবে ঢাকা পৌঁছালেন রবার্ট লুইস প্রাউডলক।
প্রাউডলকের জন্ম ইংল্যান্ডের নর্থাম্বারল্যাণ্ডে, ১৮৬২ সালে। স্থানীয় একটি নার্সারিতে কিছুদিন কাজ শেখার পর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার জন্য তিনি চলে যান এডিনবার্গ। ১৮৮৬ সালে শিক্ষানবিশ রূপে তিনি যোগ দিলেন লন্ডনের কিউ উদ্যানে। দুবছর হাতে-কলমে শিখলেন উদ্যানতত্ত্বের নানা বিষয়। এর পর প্রাউডলক রওনা হলেন ভারতের পথে; কর্মজীবন শুরু করলেন কলকাতার রয়্যাল বোটানিক্যাল গার্ডেনের সহযোগী কিউরেটর পদে।
শীতপ্রধান দেশ ছেড়ে উষ্ণ মণ্ডলে এসে উদ্যান রচনা ছিল তাঁর জন্য দারুণ চ্যালেঞ্জিং এক কাজ। স্বাভাবিকভাবে এই অঞ্চলের জন্য জুতসই গাছপালা সংগ্রহের প্রয়োজন পড়ল। তৎকালীন বার্মা থেকে সংগ্রহ করলেন নানা প্রজাতির পাঁচ শ গাছের নমুনা। তবে কলকাতার উষ্ণ ও আর্দ্র আবহাওয়া, আর ঘন ঘন ম্যালেরিয়া ও উদরাময়ে তাঁর স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ল। কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে গেলেন বম্বে। সেখানে রাবার চাষের দেখাশোনা করলেন কিছুদিন। এর পর কিছুদিন কাটালেন দক্ষিণ ভারতের নীলগিরিতে।
এ সময় রেঙ্গুন নগরের ল্যান্ডস্কেপিংয়ের কাজ পেলেন প্রাউডলক। প্রায় নয় মাস রেঙ্গুনে তাঁর কর্মব্যস্ত সময় কাটল। ল্যান্ডস্কেপিংয়ের খুঁটিনাটি বিভিন্ন বিষয় প্রথম প্রয়োগের সুযোগ তিনি পেলেন রেঙ্গুনে। সেখানে থাকতেই চিঠি এল, গভর্নর হেয়ার তাঁকে ডেকেছেন ঢাকায়। নবগঠিত প্রদেশের সিভিল স্টেশন রমনাকে সাজানোর দায়িত্ব পড়েছে তাঁর ওপর।
ড’স সে সময় নেপাল থেকে ক্যাসুরিনা গাছের চারা আনিয়ে নতুন সড়কের দুধারে রোপণ করেন। ড’সের ঢাকা ত্যাগের পর গোটা রমনাকে ঘিরে তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়নকাজের নজির পাওয়া যায় না। তবে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ঢাকার নওয়াব আব্দুল গনি ও তাঁর উত্তরসূরিদের হাত ধরে রমনার পশ্চিমাংশ এক নতুন রূপ পায়। নওয়াবদের তৈরি বাগানবাড়ি, দরবার কক্ষ, চিড়িয়াখানা আর মনোরম বাগানে রমনার একাংশ সজ্জিত হয়ে ওঠে।
১৯০৯ সালে ঢাকার কাজে যোগ দিলেন প্রাউডলক। রমনাকে নিয়ে তখন তাঁর নানা স্বপ্ন। এলাকাটাকে তিনি গড়ে তুলতে চান প্যারিসের মতো করে। গভর্নর তাঁকে দিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। রমনাকে প্রাউডলক পরিণত করলেন রমনা গ্রিনে, যার বিস্তার বর্তমান সেক্রেটারিয়েট থেকে শুরু করে নীলক্ষেত পর্যন্ত। পৃথিবীর অন্য উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চল থেকে সুদর্শন সব বৃক্ষের চারা আনিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় সেগুলো রোপণ করলেন ঢাকায়। স্থানীয় নমুনা সংগ্রহের জন্য নিজে ছুটে গেলেন চট্টগ্রাম, খুলনা থেকে শিলং, দার্জিলিং পর্যন্ত। সেসব কাজে তাঁর নিত্যসঙ্গী তখন অখিল চন্দ্র চক্রবর্তী। দেশি-বিদেশি বৃক্ষের সমাবেশে এমন এক ঢাকা গড়ে তুলতে চাইলেন প্রাউডলক, যেখানে বছরের বারো মাসই ফুল ফুটবে। কেমন ছিল প্রাউডলকের সেই পরিকল্পনা? এর কিছুটা দেখেছেন ঢাকার প্রবীণ নাগরিকেরা।
কার্জন হলের সামনের সড়কে সিলভার লিফ ওক, ফুলার রোডে জারুলের সারি, সেক্রেটারিয়েট ঘিরে পাদাউকের সারি, ঢাকা ক্লাব থেকে সড়ক ভবন পর্যন্ত সেগুনের বীথি, নিউমার্কেটের পশ্চিমে বটবীথি, হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের রাস্তায় গ্লিরিসিডিয়ার দীর্ঘ সারি, শাহবাগে কৃষ্ণচূড়া, ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে গগন শিরীষ—এ রকম অনেক উদাহরণ উল্লেখ করেছেন তিনি, যার অধিকাংশ রোপণ করেছিলেন প্রাউডলক ও তাঁর সহযোগী অখিল বাবু।
বঙ্গভঙ্গ রদের কারণে প্রাউডলক তাঁর পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন করতে পারলেন না। ঢাকায় আট বছর আট মাসের কর্মজীবন শেষে তিনি ভারতবর্ষ ছেড়ে ফিরে যান বিলেতে। তবে ঢাকাকে তিনি কখনো ভুলতে পারেননি। স্বপ্নের মতো সাজাতে চেয়েছিলেন যে শহরকে, সে শহরে তিনি ফিরে এসেছেন বারবার। ১৯২৯ সালে স্ত্রী রোসেটাকে নিয়ে এসেছিলেন ঢাকা, থেকেছিলেন প্রায় ছয় মাস। ব্যক্তিজীবনে ম্যালেরিয়ায় বড্ড ভুগেছিলেন; তাই মশা দমনের দেশীয় পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু কাজ করেছিলেন সে সময়ে। প্রাউডলক ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৮৫ বছর বয়সে পরলোকগমন করেন।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, গত শতকের সত্তর দশকের শেষভাগে ব্যাপক বৃক্ষনিধনের ফলে নিসর্গশোভার প্রায় সবটুকুই হারায় ঢাকা। এর পর কেটে গেছে আরও চার দশক। কখনো রাস্তা বড় করা, কখনো নতুন ভবন তৈরি, আবার কখনো নিরাপত্তার অজুহাতে কুড়ালের কবলে পড়েছে একের পর এক শতাব্দীপ্রাচীন বৃক্ষ। দুষ্প্রাপ্য থেকে বিলুপ্তির খাতায় নাম লেখানো উদ্ভিদরাজির সংখ্যাও কম নয়। গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে শীতল ছায়া দেওয়া বৃক্ষের এখন বড় অভাব, শীতের ঝরে পড়া পাতার দেখা মেলাও এ শহরে ভার। উজ্জ্বল নীল আকাশটাকে ধুলায় ধূসরিত করে ফেলেছে এই শহর। আর ওদিকে নিষ্প্রাণ রমনার বিচ্ছিন্ন প্রান্তে প্রাউডলকের রোপণ করা অল্প কয়টি গাছ গুনছে তাদের জীবনের শেষ দিনগুলি।
সহায়ক সূত্র:
১. দ্য জার্নাল অব দ্য কিউ গিল্ড, জুন, ১৯৩৬
২. শ্যামলী নিসর্গ, দ্বিজেন শর্মা, বাংলা একাডেমি, ১৯৮০
লেখক: অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা