এ বছর আগেভাগেই জেঁকে বসেছে শীত। শহরের বাবুদের শীত নিয়ে হাহাকার দেখে প্রকৃতি বুঝি এবার করুণা করলেন। তাই খানিকটা অকালেই এসে পড়েছেন। হাড় কাঁপিয়ে দিতে শৈত্যপ্রবাহ আসন্ন বলেও জানাচ্ছে আবহাওয়া বিভাগ। রাজধানীতে যাঁরা সারা বছর শীত উপভোগের জন্য বুভুক্ষু থাকেন, এটাই সময় তাঁদের উত্তরবঙ্গ যাওয়ার!
ভাগ্য ভালো হলে দেখা মিলতে পারে মাঙ্কি টুপিরও। সৌভাগ্যের কথা বলছি কারণ, বাঁশের আগায় অ্যানটেনা বাঁধা ঝিরঝিরে সাদাকালো রোমান্টিক টেলিভিশনের মতো এই টুপিও এখন বিলুপ্তপ্রায়।
অথচ এককালে উত্তরের জার থেকে বাঁচতে এই হনুমান টুপির বিকল্প ছিল না। সস্তার গরম কাপড়ের দোকানগুলোতে শোভা পেত কত রং-বেরঙের টুপি, কাঠের চলায় পেরেক মেরে বানানো আঁকশিতে বানরের মতো ঝুলে থাকত। এত সস্তায় শীত নিবারণের এমন মোক্ষম পোশাক সম্ভবত উত্তরের মানুষ কখনো পায়নি!
১৮৫৪ সালের ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময় ‘ব্যাটল অব বালাক্লাভা’ থেকেই টুপিটির এমন নামকরণ। এগুলো ছিল হাতে বোনা। ব্রিটিশ সেনাদের জন্য রসদ (গরম কাপড়, পানিরোধী প্যান্ট এবং খাবার) সময়মতো পৌঁছায়নি। কারণ, এসব যাচ্ছিল জলপথে। ফলে শীত থেকে বাঁচতে এটা জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয়েছিল।
রিচার্ড রাট তাঁর ‘হিস্ট্রি অব হ্যান্ডনিটিং’ বইয়ে লিখেছেন, ক্রিমিয়া যুদ্ধের সময় ‘বালাক্লাভা হেলমেট’ নামটি ব্যবহার করা হয়নি। যুদ্ধের অনেক পরে ১৮৮১ সালে এই নাম ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়।
অবশ্য টুপির মতো দেখতে শিরস্ত্রাণ উনিশ শতকের পোলিশ এবং প্রুশিয়ার সেনাদের ব্যবহার করতে দেখা যায়। তারা এটিকে বলত, উহলান ক্যাপ। তা ছাড়া ক্রীড়াবিদেরা ‘টেম্পলার ক্যাপ’ নামে এ ধরনের টুপি পরতেন।
ভারতে এসে ‘মাঙ্কি টুপি’ নাম পাওয়ার একটা বড় কারণ হতে পারে—এ ধরনের টুপির রং সাধারণত মেটে, আর মুখের মাথার অধিকাংশ ঢেকে ফেলে বলে মুখটা হনুমানের মতোই লাগে!
যা হোক, সেই দিন গেছে। এই টুপি এখন হলিউডে গিয়ে মানসম্মান হারিয়ে চোর-ছ্যাচ্চড় ছিনতাইকারীর মুখোশে অধঃপতিত হয়েছে! ভারতবর্ষে অনেক পরে এলেও এরই মধ্যে এই টুপির সামাজিক মর্যাদা তলানি পৌঁছে গেছে। উত্তরবঙ্গের গ্রামেগঞ্জে কিছু দেখা যায়। শহরের মানুষ অনেক আধুনিক হয়েছেন। মাঙ্কি টুপির স্থান দখল করেছে হুডি, উলের মাফলার। হাতে বোনা উলের টুপিও পাওয়া যায়, ফ্যাশন দুরস্ত, দামও বেশ।
অবশ্য গ্রামে অনেকে এখনো পরেন। ফাঁকা ধু ধু মাঠে কনকনে শীতের মধ্যে খেতের ফসল দেখতে বের হওয়া চাষি, অথবা মোটরসাইকেল চালক, যে গরমের কারণে সারা বছর হেলমেট পরে না, শীতকালে তার ভরসা ওই মাঙ্কি টুপি।
ইংরেজদের হাত ধরে আসা এই এক অনন্য পোশাক স্থান করে নিয়েছিল গরিব, মধ্যবিত্তের ঘরে। যুগ বদলেছে, বদলে গেছে আর্থসামাজিক অবস্থা। আরও অনেক কিছুর মতো মাঙ্কি টুপিও এখন মুক্তবাজার অর্থনীতির জেল্লায় ম্রিয়মাণ কোণঠাসা। ফলে পোশাকও যে আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থানের চিহ্ন, সেটিও হয়তো চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে ওই ব্র্যান্ডের লোগো লাগানো স্কাল ক্যাপ। অর্থনৈতিক উদারীকরণের জোয়ারে ‘উন্নত’ সংস্কৃতির ছোঁয়া যাদের ঘর পর্যন্ত এখনো পৌঁছায়নি রক্ষণশীল মধ্যবিত্তের মতো (আসলে সামর্থ্যহীনতা), তারাই এখনো শীতের সকালে বাইরে বেরোনোর সময় দুই হাতে টেনে মাথায় ঢোকান হনুমান টুপি।