Ajker Patrika

ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে একনায়ক হওয়ার পথ করে দিল পাকিস্তানের পার্লামেন্ট

আপডেট : ১৫ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ২১
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফিল্ড মার্শাল মুনির এখন নৌ ও বিমান বাহিনীরও তত্ত্বাবধান করবেন।
২০২২ সালের নভেম্বর থেকে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করা ফিল্ড মার্শাল মুনির এখন নৌ ও বিমান বাহিনীরও তত্ত্বাবধান করবেন।

এক নতুন সামরিক–রাজনৈতিক বাস্তবতায় প্রবেশ করল পাকিস্তান। ইসলামাবাদের পার্লামেন্ট ভবনে যেদিন সংবিধানের ২৭তম সংশোধনী পাস হলো। সিনেটে সামান্য হই হই চই এবং দুজন বিচারকের পদত্যাগ ছাড়া অনেকটা নিরবেই পাকিস্তানের ক্ষমতা কাঠামোয় ঐতিহাসিক রূপান্তর ঘটে গেল।

যৌথতা, আধুনিকায়ন ও কার্যকারিতার নামে একটি রাষ্ট্রকে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক সামরিক আধিপত্যের দিকে ঠেলে দেওয়ার লিখিত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জনসাধারণের সামনে ‘সামরিক পুনর্গঠন’ হিসেবে তুলে ধরা হলেও পরিবর্তনকে একেবারে ‘সংবিধানপ্রণোদিত সামরিক একনায়কতন্ত্রের সূচনা’ বলছেন বিশ্লেষকেরা।

গত বৃহস্পতিবার আইনে পরিণত হওয়া সংবিধানের এই সংশোধনীর মাধ্যমে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে সর্বময় সামরিক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার ও বিচার থেকে আজীবন দায়মুক্তি পেয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, গণতান্ত্রিকভাবে দুর্বল পাকিস্তানের জনগণের জন্য কিছুটা ভরসার জায়গা বিচার বিভাগকেও দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে।

পারমাণবিক ক্ষমতাধর পাকিস্তানে রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নতুন নয়। অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল এবং পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ার নজির বহু আছে। জেনারেল পারভেজ মোশাররফ ও জেনারেল জিয়া-উল-হক তাঁর উদাহরণ। কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করে সামরিক ক্ষমতাকে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর স্থান দেওয়ার এই ঘটনা নজিরবিহীন ও সুদূরপ্রসারী।

১. সংবিধানের এই সংশোধীর ফলে সেনাপ্রধান আসিম মুনির প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধান (সিডিএফ) হলেন। অর্থাৎ তিন বাহিনী, কৌশলগত কমান্ড, এমনকি পারমাণবিক বাহিনী তত্ত্বাবধানকারী কাঠামোর ওপরও তাঁর পূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলো। এর ফলে কার্যত তিন বাহিনীর ভেতরের ভারসাম্য ভেঙে গেল। তিন বাহিনীর যৌথ নেতৃত্বের দীর্ঘ ৫ দশকের প্রাতিষ্ঠানিক ভূমিকা বাতিল হয়ে সেনাপ্রধানের একনায়ক হওয়ার পথ তৈরি হলো।

এই পরিবর্তনকে ‘আধুনিক যুদ্ধের প্রয়োজনে নেওয়া পদক্ষেপ’ বলে দাবি করছে পাকিস্তান সরকার। কিন্তু বাস্তবে এর মাধ্যমে সর্বময় ক্ষমতা পেয়েছেন সেনাপ্রধান— প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানের ভূমিকা, ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব অত্যন্ত উন্মুক্ত রাখা হয়েছে; তাঁর সিদ্ধান্তের ওপর পার্লামেন্টের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়নি এবং এই পদের দায়িত্ব ও বাহিনীর কাঠামো ঠিক নির্ধারণের দায়িত্ব স্পষ্ট করা হয়নি। এই পরিবর্তন পাকিস্তানের ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্স’ ব্যবস্থা দুর্বল করে সামরিক কাঠামোকে আরও বেশি ব্যক্তিনির্ভর করে তুলেছে।

বিমানবাহিনীর সাবেক প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল আব্বাস খট্টাক ডনকে বলেছেন, আধুনিক যুদ্ধের বাস্তবতা বলে, বিমান, নৌ ও স্থল বাহিনীর স্বাধীনতা ও সমন্বয়ই শক্তির উৎস। কিন্তু পাকিস্তান উল্টোপথে হাঁটছে। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বিশ্বমানের চর্চা থেকে সরে যাই, তাহলে এককেন্দ্রিক ক্ষমতা ভবিষ্যতে কৌশলগত ভুলের ঝুঁকি বাড়াবে।’

বিশেষ করে নতুন ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডের অধীনে তিন বাহিনীর পারমাণবিক ডেলিভারি সিস্টেম এক ছাতার নিচে আনা হলে বিমান ও নৌবাহিনীর কৌশলগত স্বাধীনতা আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

জর্জটাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আকিল শাহ খোলাখুলি বলেছেন, ‘এটি মুনিরের ক্ষমতার দখলকে আরও পাকাপোক্ত করেছে। পার্লামেন্ট এমনভাবে একজন সামরিক প্রধানের আধিপত্যকে বৈধতা দিয়েছে, যা আমরা আগে কখনও দেখিনি।’ (দ্য গার্ডিয়ান) শাহের মতে, বিচার বিভাগ ও সংসদ উভয়কেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে প্রান্তে—যা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য নয়।

২. পাকিস্তানের পারমাণবিক কাঠামো এখনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব থাকলেও সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে কর্তৃত্বের ভারসাম্য বদলে গেছে। ন্যাশনাল কমান্ড অথরিটি–এনসিএ কাঠামোগতভাবে এখনও বেসামরিক নেতৃত্বাধীন। কিন্তু ন্যাশনাল স্ট্র্যাটেজিক কমান্ডারের (সিএনএসসি) নিয়োগ, পুনঃনিয়োগ ও মেয়াদ বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত এখন নির্ভর করবে কেবলমাত্র সিডিএফের সুপারিশের ওপর।

কেবল তাই নয়, কফিনে শেষ পেরেক ঠুকার মতো এই সিদ্ধান্তের ওপর বিচার বিভাগীয় পর্যালোচনা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সংশোধিত সংবিধানের ধারা ৮ই (২) অনুযায়ী, সিএনএসসির নিয়োগ বা মেয়াদ বৃদ্ধির বিষয়টি কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এটা পাকিস্তানের সংবিধানের ৪, ৯ ও ১৯৯ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। কারণ, রাষ্ট্রের সকল নাগরিক আইনের সামনে সমান এবং প্রশাসনিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার সাংবিধানিক অধিকার।

পাকিস্তানের সাবেক সামরিক আইন কর্মকর্তা ইনাম-উর-রহিম বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীর যেকোনো সিদ্ধান্ত, যদি তা অনিয়ম বা কর্তৃত্ববহির্ভূত হয়, তা উচ্চ আদালতে বিচারযোগ্য— এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত নীতি।’

এটা পাকিস্তানের পারমাণবিক স্থাপত্যে সেনাবাহিনীর প্রভাবকে আরও স্থায়ী করে তুলছে, যা আইনের শাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।

৩. সামরিক কাঠামোর এই পুনর্গঠনের অন্যতম ফল হলো ক্ষমতার চূড়ান্ত কেন্দ্রে একজন ব্যক্তির দীর্ঘায়িত মেয়াদ। প্রতিরক্ষা বাহিনী তথা সেনাবাহিনীর প্রধানের মেয়াদ ২০৩০ সাল পর্যন্ত বাড়ানো এবং নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে তা ২০৩৫ পর্যন্ত যাওয়ার সুযোগ তৈরি করা। অর্থাৎ পাকিস্তানের পুরো প্রতিরক্ষা কাঠামো প্রায় এক দশকজুড়ে এক ব্যক্তির সিদ্ধান্ত, দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক অবস্থানের ওপর নির্ভরশীল হবে।

সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে দীর্ঘায়িত ও সর্বময় ক্ষমতার পাশাপাশি কোনো অপরাধে গ্রেপ্তর ও বিচার থেকেও আজীবন দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রতিরক্ষা সচিব লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব) আসিফ ইয়াসিন মালিক এই বিষয়ে কড়া মন্তব্য দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘মনে হচ্ছে এক ব্যক্তির জন্য আইন করা হলো, প্রাতিষ্ঠানিক কল্যাণের জন্য নয়।’ (ডন)

তাঁর মতে, তিন বাহিনীর প্রয়োজনে নয়, একজন ব্যক্তিকে সামনে রেখে এই আইন প্রণীত হলো। পাকিস্তানের সাবেক রাষ্ট্রদূত মালিহা লোধির মতে, ‘এই আইনি পুনর্গঠন শুধু সামরিক ক্ষমতা বাড়ায়নি, পাকিস্তানের বিচার কাঠামোকেও দুর্বল করে দিয়েছে।’

. নিজ বাহিনীর ভেতরে পদোন্নতি-বদলির বিষয়ে বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানের ক্ষমতা খর্ব হলো। এখন এই বাহিনী প্রধানদের হাতে কেবল থ্রি স্টার অর্থাৎ লেফটেন্যান্ট জেনারেল ও নিচের পদমর্যাদার পদোন্নতি-বদলির ওপর ক্ষমতা থাকল। ফোর স্টার সব নিয়োগ ভবিষ্যতে প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রধানের সঙ্গে ‘আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক পরামর্শে’ হবে। অর্থাৎ বাকি দুই বাহিনী প্রধানদের ভূমিকা ও প্রভাব কমল।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পুরনো কাঠামোতে সমস্যা থাকলেও নতুন কাঠামো কোনো সমাধান নয়। সিজেসিএসসি বহু বছর ধরেই আনুষ্ঠানিক পদ হিসেবে ছিল এবং তিন বাহিনী কার্যত সমান্তরাল আমলাতন্ত্রের মতো চলত। কিন্তু যেভাবে পাকিস্তানে সেনাপ্রধানকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হলো, সেই পথটি উল্টো। যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো দেশও তিন বাহিনীতে যৌথতা এনেছে, তবে স্বাধীন যৌথ কমান্ড গড়ে তুলে।

বাস্তবে ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের অধীনে সামরিক কাঠামো এখন এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যেখানে— বাহিনীসমূহের ভারসাম্য দুর্বল, বিচার বিভাগের ভূমিকা সংকুচিত, পারমাণবিক স্থাপত্যে সেনাবাহিনীর আধিপত্য সুসংহত, এবং প্রতিরক্ষা নীতি-পরিকল্পনা কার্যত একজন ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দের ওপর নির্ভরশীল।

এমন পরিবর্তনে উদ্বেগ তুলে ধরে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বিশ্লেষক মজিদ নিজামী আল জাজিরাকে বলেন, সিডিএফের নতুন ভূমিকা অস্পষ্ট এবং তিন বাহিনীর কৌশলগত সমন্বয় বিপর্যস্ত হতে পারে। কাঠামোর অস্পষ্টতা ভবিষ্যতের সংঘাতে সিদ্ধান্ত বিভ্রান্তি ডেকে আনতে পারে বলে তিনি সতর্ক করেন।

সিদ্ধান্ত গ্রহণ, নিয়োগ–বদলি ও কৌশলগত বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ এক ব্যক্তির হাতে কেন্দ্রীভূত হলে রাষ্ট্র প্রাতিষ্ঠানিক শক্তি হারাবে। সেই মুহূর্তে একনায়কতন্ত্র আর সম্ভাবনার পর্যায়ে থাকে না, তা বাস্তবে পরিণত হওয়ার ঝুঁকি তৈরি করে। পাকিস্তান সেই রূপান্তরের দুয়ারে দাঁড়িয়ে। কারণ, পার্লামেন্ট যে আইন পাস করেছে, তা শুধু প্রশাসনিক কাঠামো পাল্টায়নি, রাষ্ট্রকে কার্যত এক ব্যক্তিনির্ভর সামরিক সিদ্ধান্তপ্রক্রিয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে।

পাকিস্তানের বেসামরিক সরকার কি তার কার্যক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে? সেনাবাহিনীর তিন শাখার মধ্যে ভারসাম্য কি বজায় থাকবে? বিচার বিভাগ ও সংসদ কি একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়তে সক্ষম হবে? সময় জবাব দেবে এসব প্রশ্নের।

Google News Icon

সর্বশেষ খবর পেতে Google News ফিড ফলো করুন

বিদেশে নেওয়ার অবস্থায় নেই খালেদা জিয়া

এনসিপি-এবি পার্টি-রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন জোট চূড়ান্ত, ঘোষণা বিকেলে

আজকের রাশিফল: সন্ধ্যায় অচেনা নম্বর থেকে ‘দারুণ অফার’ আসবে, ইগনোর করুন

পাকিস্তানি স্ত্রীকে করাচিতে ফেলে ভারতে দ্বিতীয় বিয়ের প্রস্তুতি, স্বামীর বিচার চেয়ে মোদির কাছে আবেদন

বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য অস্ট্রিয়ায় টিউশন ফি নেই

এলাকার খবর
Loading...