দেশের শিক্ষাঙ্গনে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেছেন, ‘দেশের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্র–শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে বিভিন্ন আলোচনা হচ্ছে। সবার মতামত গ্রহণ করে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করবে। তবে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ যে অপরাজনীতি করেছে, সেই রাজনীতি যেন ক্যাম্পাসে ফিরে না আসে—সেটা আমাদের অঙ্গীকার।’
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে গত ৫ আগস্ট। জুলাইয়ের শুরুতে সূত্রপাত হওয়া এই আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
আজ রোববার তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি কার্যালয় শাপলায় বেলা ১১টা থেকে এ মতবিনিময় সভা শুরু হয়, চলে বেলা দেড়টা পর্যন্ত। এতে ১৫০ জন শিক্ষার্থী অংশ নেন।
মতবিনিময় সভায় ড. মুহাম্মদ ইউনূস, তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে শিক্ষার্থীদের কাছে গিয়ে কথা বলতে এবং খোঁজখবর নিতে দেখা যায়। সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল; বন, পরিবেশ ও জলবায়ু উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ ফরিদা আখতার।
বিকেলে রাজধানীর তেজগাঁও অবস্থিত প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে ছাত্রসংগঠক এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের ছাত্রপ্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা ও অন্য উপদেষ্টারা। পরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে হাজির হন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।
মাহফুজ আলম সাংবাদিকদের জানান, শিক্ষার্থীদের এক প্রশ্নের জবাবে ভারত–বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়ে বর্তমান সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস।
সেখানে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষক–ছাত্র রাজনীতি বিষয়টি উঠে এসেছে। এ প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম বলেন, ‘ছাত্র–শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে প্রতিটি ক্যাম্পাসে আলোচনা হচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখন স্পষ্ট গাইডলাইন দেওয়া হয়নি। কোন ফরম্যাটে রাজনীতি হবে, সেই আলোচনা সব জায়গায় চলছে। আমরা চাই, সমাজের বিভিন্ন অংশ ও ক্যাম্পাস এবং ক্যাম্পাসের বাইরে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হোক। এরপর যে সারসংক্ষেপ আসবে, সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার তার অবস্থান পরিষ্কার করবে।’
তিনি বলেন, ছাত্রদের প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক দরকার। কিন্তু সেই সম্পর্ক হবে ন্যায্যতা এবং সমতার ভিত্তিতে। প্রতিবেশীর সঙ্গে পারস্পরিক সমান সম্মান এবং ন্যায্যতার ভিত্তিতে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে তিনি গুরুত্বারোপ করেন। একই সঙ্গে সার্ককে আরও কার্যকর করতে উদ্যোগ নেওয়া হবে।
মাহফুজ আলম জানান, আজকে এ সরকারের এক মাস পূর্ণ হয়েছে। গণ–আন্দোলনের সামনে ও পেছন থেকে নেতৃত্বে দিয়েছেন যাঁরা, তাঁদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে নানা বিষয় আলোচনা এসেছে। ছাত্ররা বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও পরিবর্তনের কথা বলেছেন।
সরকারের তরফ থেকে হতাহতদের বিষয়ে কী কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, সেই বিষয়গুলো আলোচনা হয়েছে। একটি ফাউন্ডেশন কাজটি দ্রুত এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এর মাধ্যমে শহীদ পরিবারকে ক্ষতিপূরণ, আহত পরিবারকে পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সম্মানের বিষয়টি আলোচনা হয়েছে।
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি করার বিষয়টি এনেছেন। এ ব্যাপারে সরকারকে সতর্ক থাকার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। সরকারপ্রধান সেটি শুনেছেন, কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি। মাহফুজ আলম বিষয়টি স্পষ্ট করে বলেন, সেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নয়, আলোচনা হয়েছে ধর্মকে নিয়ে অপরাজনীতি করার বিষয়ে।
গণমামলার প্রসঙ্গে মাহফুজ আলম বলেন, এ ব্যাপারে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার। এগুলো কোনোভাবেই হতে দেওয়া যাবে না। কোনো ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে হামলা–মামলা করতে পারবে না। যারা ফ্যাসিবাদের দালাল ও দোসর হিসেবে কাজ করেছে, তাদের বিচার অবশ্যই হবে।
মাহফুজ বলেন, সবাইকে শুধু এতটুকু খেয়াল রাখবেন, যাতে কোনো কম্প্রোমাইজ না হয়; শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে বেইমানি না হয়। সরকার এ ব্যাপারে কঠোর। এখনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে, ভবিষ্যতে আরও নেওয়া হবে। তবে জনগণ যাতে নিজের হাতে আইন তুলে না নেয়, সরকারের বার্তা সেটাই।
মাহফুজ আলম বলেন, যারা এত দিন নানা প্ল্যাটফর্মে আসতে পারেননি, তাঁদের আজকে ডাকা হয়েছে। ধীরে ধীরে বাকিদের ডাকা হবে। সবাই সরকারকে তাঁদের পরামর্শ দেবেন, সেই সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হবে।
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আরও বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের পর গঠিত এই সরকারের মেয়াদ এক মাস পূর্ণ হয়েছে। সেই জায়গা থেকে আজকের ছাত্রদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন প্রধান উপদেষ্টা। সেখানে ছাত্ররা তাঁদের মতামত জানিয়েছেন। নানা সংস্কারকাজে হাতে দেওয়ার বিষয়টি প্রধান উপদেষ্টা তাঁদের অবহিত করেছেন। সরকারের অন্য উপদেষ্টারাও মতামত দিয়েছেন।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি শফিকুল আলম বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ১৫০ জন আজকে তাঁদের কথা বলেছেন। প্রধান উপদেষ্টা সবার কথা শুনেছেন। তিনি যখন বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতের বর্ণনা দিচ্ছিলেন তখন সবাই হু হু কাঁদছিলেন।
শফিকুল আলম বলেন, ‘আহত ও নিহতের তালিকা তৈরি করতে খুব ভালোভাবে কাজ করছে সরকার। প্রায় ১৮ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে জানতে পেরেছি। প্রথম দিকে ছাত্ররা ছিল, পরে দেশব্যাপী সাধারণ মানুষ এই আন্দোলনে যুক্ত হয়। এ জন্য এই তালিকা অনেক লম্বা হচ্ছে।’
তিনি জানান, অনেকেই পুলিশি ঝামেলার কারণে ময়নাতদন্তের প্রক্রিয়ায় যাননি। ফলে সবার তথ্য সংগ্রহ করতে একটু বেগ পেতে হচ্ছে। অনেকেই জানাজা তাড়াতাড়ি করেছেন পুলিশি ঝামেলার এড়াতে। ঢাকা মেডিকেলসহ বিভিন্ন হাসপাতালে নেওয়ার পর অনেকে মারা গেছেন, তাঁদের লাশ দাফন হয়েছে সবার অগোচরে। এসব তালিকা ত্বরিত গতিতে করার চেষ্টা হচ্ছে। প্রাথমিক একটি তালিকা হয়েছে। এখন ছাত্ররা করছেন, প্রাইভেটলি হচ্ছে। সব তালিকা পাওয়ার পর সমন্বিত একটি তালিকা প্রকাশ করা হবে।
ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার উপপ্রেস সচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীরও উপস্থিত ছিলেন।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে