কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারের আসামিদের ঘিরে চলছে চুক্তিতে জামিন-বাণিজ্য। খোদ কারারক্ষীরাই এমন বাণিজ্যে জড়িত। একই সঙ্গে কারারক্ষীদের সিন্ডিকেটে চলে মাদক কারবারও। সম্প্রতি জেলা কারাগারে থাকা ও জামিনে মুক্তি পাওয়া আসামিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এসব আসামির সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ডও সংরক্ষিত আছে।
কুড়িগ্রাম জেলা কারাগারে চারটি পুরুষ ও দুটি নারী ওয়ার্ড মিলে মোট আসামি ধারণক্ষমতা ১৬৩। গত সোমবারের তথ্য অনুসারে, এই কারাগারে রয়েছেন ৩২০ জন। কারা সূত্রে জানা গেছে, বন্দী থাকা বেশির ভাগ আসামি মাদক মামলার। আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় সেখানে গাদাগাদি করে থাকতে হয়। ফলে অনেকেই দ্রুত মুক্তি চান। এই সুযোগ নেয় কারারক্ষীদের সিন্ডিকেট।
এসব অভিযোগ ওঠার পর আজকের পত্রিকার অনুসন্ধানে জানা যায়, সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িতের মধ্যে রয়েছেন কারারক্ষী রেজাউল করিম, বাদশা মিয়া, গোলাম মোস্তফা, আসলাম হোসেন ও আল-আমিন।
এ নিয়ে সম্প্রতি কারাগারে থাকা দুই আসামির সঙ্গে কথা বলেন এই প্রতিবেদক। এই দুই আসামি রৌমারী থানার। মাদক মামলায় কারাগারে রয়েছেন তাঁরা। দুই আসামি জানান, নিম্ন আদালতে জামিন আবেদন করলে তা নাকচ হয়। এরপর কারারক্ষীদের ওই চক্র তাদের জামিনের চুক্তি নেয়। উচ্চ আদালত থেকে জামিন করিয়ে দেওয়ার শর্তে ওই কারারক্ষীদের টাকা দেন। তবে এখনো জামিন হয়নি। গত সোমবার পর্যন্ত তাঁরা কারাগারে ছিলেন। কারারক্ষীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, দেশের ‘বিশেষ পরিস্থিতির’ কারণে জামিন বিলম্ব হচ্ছে।
ওই দুই বন্দী বলেন, ‘কারারক্ষী রেজাউল জামিনের কাজ নিছে। চুক্তি মোতাবেক আমাদের পরিবার তাঁকে ৫০ হাজার করে টাকা দিয়েছে।’ তাঁরা বলেন, ‘কারারক্ষী বাদশা মিয়া কথা বলায় দিছে। রেজাউল জামিনের দায়িত্ব নিছে।’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে কারারক্ষী রেজাউল করিমের সঙ্গে কারাগারে গিয়ে দেখা করার চেষ্টা করা হলেও সম্ভব হয়নি। পরে তাঁকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ফোন ধরেননি। তবে অভিযোগের বিষয়ে কারারক্ষী আসলাম হোসেন বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বলছে। তবে যাঁদের নাম বলছেন (রেজাউলসহ অন্যরা), তাঁরা জামিন কন্ট্রাক্ট করে বলে কারাগারে অনেকে জানেন। কারারক্ষী বাদশা জড়িত আছে কি না আমার জানা নেই। পুরোনো আসামিরা নতুন আসামিদের সঙ্গে আলাপ করে জামিন চুক্তিকারী কারারক্ষীদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। পরে ওই কারারক্ষীরা তাঁদের সিন্ডিকেটের আইনজীবীদের মাধ্যমে জামিনের ব্যবস্থা করেন।’
এদিকে সম্প্রতি এই কারারক্ষী চক্রের মাধ্যমে জাহের আলী ফকির নামে এক বন্দী জামিনে মুক্তি পান। জাহের আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়। কারাগারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, অভিযুক্ত কারারক্ষীদের মধ্যে আসলাম হোসেন সমন্বয়কারী। তাঁর পরামর্শে অন্য কারারক্ষীরা বন্দীদের সঙ্গে জামিনের চুক্তি করেন।
পরে আদালতে গিয়ে তাঁদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ আইনজীবীদের মাধ্যমে জামিনের ব্যবস্থা করেন। এই চক্রে আদালতের কয়েকজন অসাধু কর্মচারীও জড়িত।
চুক্তিতে মুক্তি এ অভিযোগ স্বীকার করেছেন জেলার আবু ছায়েম। তিনি বলেন, ‘আমরাও এমন অভিযোগ পাই। কিন্তু সুনির্দিষ্ট প্রমাণ না থাকায় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। নানা অভিযোগ থাকায় এর আগে কয়েকজন কারারক্ষীকে অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল।’
এদিকে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া একাধিক আসামির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শুধু জামিন নয়, কারাগারের অভ্যন্তরে মাদক সরবরাহে কয়েকজন কারারক্ষী জড়িত। এই কারারক্ষীদের মধ্যে অনেকে মাদকাসক্ত রয়েছেন। তাঁদের ডোপ টেস্টের প্রশ্নে জেলার বলেন, ‘আমি মনে করি কর্তৃপক্ষ তেমন ব্যবস্থা নিতে পারে এবং নেওয়া উচিত।’
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ বলেন, ‘কয়েকজন কারারক্ষীর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ উঠেছিল। তাঁদের বদলিও করা হয়েছে। আরও কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
করাগারের একাধিক সূত্র জানায়, জামিন সিন্ডিকেট, মাদক সরবরাহসহ বিধিবহির্ভূত কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে কয়েক মাস আগে কয়েকজন কারারক্ষীকে বদলি করা হয়েছিল। তবে চক্রটি পুরোপুরি ভাঙা সম্ভব হয়নি।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে