সূত্রাপুরের গেন্ডারিয়ায় ২০০০ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর একটি জোড়া খুনের ঘটনা নিয়ে বেশ হইচই পড়েছিল। মহসিন ও সায়েম নামের দুই যুবককে অপহরণের পর পেশাদার কসাই দিয়ে তাঁদের লাশ ১২ টুকরা করে ম্যানহোলে ফেলে দিয়েছিল সন্ত্রাসীরা। সেই অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দুই ভাই—সুমন ও সুজন। ২০০৩ সালের ১৪ মে ছিল সেই মামলার রায় ঘোষণার দিন। স্বাভাবিকভাবেই সকাল থেকে আমরা আদালতপাড়ায়, বড় কাভারেজ হবে। সারা দিন দৌড়াদৌড়ির পর রাতে অফিস থেকে বেরোব, তখনই শুনি, মালিবাগে সানরাইজ হোটেলে গোলাগুলিতে দুই পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। এবার সব মাটি।
মালিবাগ রেলগেট থেকে রামপুরার দিকে যেতে ডান দিকে যেখানে এখন একটি ভবন উঠছে, সেখানে ছিল কাঁচাবাজার। বাজারের মুখে একটি চারতলা ভবনে সানরাইজ আবাসিক হোটেল। খুবই সাধারণ মানের সেই হোটেলে কোনো আবাসিক অতিথি থাকতেন বলে মনে হয়নি। তবে হোটেলটি আলোচনায় আসত পুলিশের অভিযানের কারণে। কিছুদিন পরপর পুলিশ সেই হোটেলে তল্লাশি চালাত আর খদ্দেরসহ একদল তরুণীকে ধরে নিয়ে যেত। সেই হোটেলে পুলিশ খুন হওয়ার কথা শুনে দৌড়ে গেলাম। দেখি, র্যাটের (পুলিশের তখনকার বিশেষ দল) ডিসি মাজহারুল হকের নেতৃত্বে একদল পুলিশ হোটেলটি ঘিরে। কাউকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছিল না।
তখন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) ডিসি ছিলেন ফারুক আহমেদ। তিনিও ঘটনাস্থলে ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী মোল্লা মাসুদ ও জিসান কিছুদিন ধরে এই হোটেলে অবস্থান করছিলেন বলে তাঁদের কাছে আগাম খবর ছিল। সেই খবরের ভিত্তিতে ডিবির ৩ নম্বর টিমের ১১ জন সদস্য হোটেলটিতে অভিযান চালান। হোটেলের দোতলায় ১৪ ও ২৬ নম্বর কক্ষ ছিল পাশাপাশি, দুই সন্ত্রাসী ওই দুটি কক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। ডিবির দলটি একসঙ্গে দুটি কক্ষের কড়া নাড়তেই দুই সন্ত্রাসী দলবল নিয়ে তাদের ওপর চড়াও হয়। সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে ডিবির পরিদর্শক নুর আলম শিকদার ও উপপরিদর্শক আলমগীর হোসেন ঘটনাস্থলেই মারা যান। পুলিশও অবশ্য গুলি ছুড়েছিল। সেই গুলিতে শাহাদত হোসেন উপল নামের এক সন্ত্রাসী নিহত হয়। তবে সেই ঘটনার পর ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের জিসান নামটি বেশ ছড়িয়ে পড়ে। এরপর বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনায় জিসানের নাম আসতেই থাকে।
র্যাব বাহিনী তখনো হয়নি। পুলিশের বিশেষ দল ছিল ‘র্যাট’ নামে। ডিএমপির ডিসি মাজহার ছিলেন এর নেতৃত্বে। সেই র্যাট জিসানকে ধরতে অভিযান শুরু করল, কিন্তু ধরতে পারল না। বন্ধু মোল্লা মাসুদের হাত ধরে জিসান চলে গেলেন কলকাতায়। পরে জিসানের এক আত্মীয়ের মুখে শুনতে পাই, কলকাতায় গিয়ে আলী আকবর চৌধুরী নাম নেন জিসান। সে নামেই ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে দুবাই চলে যান।
যত দূর শুনেছিলাম, কুমিল্লার ছেলে জিসানের জন্ম ১৯৭০ সালে, ঢাকার খিলগাঁওয়ে। এলাকায় ছোটখাটো মাস্তানি করতে করতে একসময় পুরোদস্তুর চাঁদাবাজ হয়ে যান। ১৯৯৮-৯৯ সালের দিকে খিলগাঁও এলাকার সন্ত্রাসী আসিফের সঙ্গে মিশে অস্ত্রবাজি ও খুনখারাবিতে জড়িয়ে পড়েন। ওই সময় ঢাকায় কালা জাহাঙ্গীর গ্রুপের সঙ্গে তাঁদের বিরোধ ছিল তীব্র। স্কুলশিক্ষিকা মায়ের সঙ্গে জিসান থাকতেন মগবাজারে। ১৯৯৭ সালের দিকে জিসান ও তাঁর ছোট ভাই শামীম রামপুরায় গার্মেন্টসের ঝুট ব্যবসা শুরু করেন। সেই ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডের সঙ্গে জিসানের পরিচয়। তখন তিনি রামপুরার শাহজাদা গ্রুপের সঙ্গে মিলে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড চালাতেন। ২০০৫ সালে দেশ ছাড়ার পর আর কোনো দিন দেশে আসেননি জিসান। তবে দেশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঠিকই ছিল। ঢাকায় থাকার সময় ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গে জিসানের ভালো সম্পর্ক ছিল। বিদেশে পালিয়ে থাকার সময় শামীম তাঁকে ব্যবহার করতে শুরু করেন। যেকোনো ঠিকাদারি কাজ বাগাতে জিসানকে কাজে লাগান শামীম। ২০১২ সালে টেন্ডারবাজি নিয়ে মগবাজারে তিনজনকে খুন করে জিসানের লোকেরা। ওই খুনের পর জি কে শামীমের বাসায় তল্লাশি করেছিল ডিবি।
খুনের ঘটনার পর শোনা গেল, রাজউক থেকে শুরু করে রেল ভবন, গণপূর্ত, ক্রীড়া পরিষদ, পানি উন্নয়ন বোর্ড, যুব ভবন, কৃষি ভবন, ওয়াসার বিভিন্ন অঞ্চলের দরপত্রের নিয়ন্ত্রণ নিতে জিসানকে ব্যবহার করছিলেন শামীম। জিসানের হয়ে ফ্রিডম মানিক ও আইমান টিটু সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন। একপর্যায়ে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার সঙ্গেও সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে জি কে শামীমের। তখন খালেদের সঙ্গেও জিসানের ভালো সম্পর্ক ছিল। খালেদের মাধ্যমে জি কে শামীম যুবলীগের একটি পদ পেয়ে জিসানের সঙ্গে লেনদেন বন্ধ করে দেন। নিজেরা রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে কাজ বাগাতে শুরু করেন। একপর্যায়ে জিসানকে টাকা পাঠানো বন্ধ করে দিলে জিসান ক্ষুব্ধ হন। এরপর জি কে শামীম ও খালেদকে হত্যার হুমকি দেন জিসান। সেই ভয়ে শামীম ও খালেদ দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা শুরু করেন। জিসানকে ধরিয়ে দিতে ঢাকায় পোস্টারও সাঁটান জি কে শামীম। ২০১৯ সালের ২৬ জুলাই খিলগাঁও এলাকার একটি বাসা থেকে একে-২২, গুলিসহ এক যুবককে গ্রেপ্তার করে ডিবি। সেই যুবক পুলিশের কাছে স্বীকার করেন, জিসানের নির্দেশে খালেদ ও শামীমকে খুন করতে তিনি ঢাকায় আসেন।
ক্যাসিনো-কাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জি কে শামীম ও খালেদ র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জিসানের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কথা স্বীকার করেছিলেন বলে র্যাবের এক কর্মকর্তা আমাকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু প্রশ্ন উঠতে পারে, এত কিছুর পর সেই জিসানকে ফিরিয়ে আনতে পুলিশের কোনো তৎপরতা নেই কেন? সেই প্রশ্নের স্পষ্ট উত্তর আমিও জানি না।
একবার খবর পেলাম, ২০১৯ সালের ১ অক্টোবর দুবাই পুলিশ ইন্টারপোলের সহায়তায় জিসানকে গ্রেপ্তার করেছে। এরপর শুরু হলো তাঁকে ফিরিয়ে আনার তৎপরতা। গ্রেপ্তার করার পর দেখা যায়, তাঁর হাতে ভারত ও ডমিনিকান রিপাবলিকের পাসপোর্ট। সেই পাসপোর্ট নিয়ে তিনি এত দিন দুবাইয়ে অবস্থান করছিলেন। গ্রেপ্তারের ১০-১২ দিন পর জিসান জামিনে মুক্তি পান। এরপরই তাঁকে ফিরিয়ে আনার সব তৎপরতা ভেস্তে যায়। এখন শুনি, জিসান দুবাই বসে গাড়ি ও রেস্তোরাঁর ব্যবসা করছেন আর খাবার চিবোতে চিবোতে মরুভূমিতে বসে বেলে ড্যান্স দেখছেন।
আসলে ক্যাসিনো-কাণ্ডের পরই জিসানকে নিয়ে বেশ আলোচনা শুরু হয়েছিল। তখন অনেকেই বলছিলেন, সেই অভিযানের সঙ্গে দুবাইয়ে জিসানকে গ্রেপ্তারের নাকি যোগসূত্র ছিল। এবার তাঁকে ফিরিয়ে আনা হবেই। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। জিসান এখনো বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব আলোচনা কেন হয়, আর কেনই-বা তা কার্যকর হয় না, তা বোধ হয় কারও চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে হবে না। বলা যায়, সবই নিয়তির খেলা...।
আষাঢ়ে নয় সম্পর্কিত আরও পড়ুন:
- ক্ষমা করবেন জ্যোতিকাবালা
- ফাঁসির সেল থেকে ফিরে আসা
- ভেস্তে যাওয়া এক ‘আষাঢ়ে গল্প’
- পিচ্চি হান্নানকে দিয়েই ‘হাতেখড়ি’ র্যাবের
- নবজাতকের সূত্রে মিলল বাংলা ভাইয়ের খোঁজ
- কই শহীদ হলেন না যে
- মুরগি মিলনের সম্পদ অন্যের হাতে
- সোনার খোঁজে আদার ব্যাপারী
- তিনি অধরাই থেকে গেলেন
- নিশ্চিন্তে দেশ ছাড়লেন টোকাই সাগর
- ৪০০ কিমি হাঁটার সেই দুঃসহ গল্প
- রঙিন জীবন অন্ধকারেই শেষ
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে