সোমবার, ২৯ মে ২০২৩

সেকশন

 

বিরোধী দলকে দুর্বল করে রাখার সরকারি সাফল্য

আপডেট : ২৩ মে ২০২৩, ০৯:২৯

বিরোধী দলকে দুর্বল করে রাখার সরকারি সাফল্য কোনো কোয়ালিশন নয়, একক শক্তি হিসেবে দেশ চালাচ্ছে আওয়ামী লীগ। পরপর টানা তিন মেয়াদে দলটি সরকার পরিচালনার সুযোগ পেয়েছে। এত দীর্ঘ মেয়াদে সরকার চালানোর সুযোগ অতীতে আর কেউ পায়নি। দেশে তেমন প্রতিবাদ-বিক্ষোভ নেই। আন্দোলন নেই। বিরোধী দল বলে তেমন কিছু নেই। যেখানে যতটুকু আন্দোলন-সংগ্রামের সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে, তা ছলে-বলে-কৌশলে হাওয়ায় মিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপাতদৃষ্টিতে দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে কিছু ‘গোপন ষড়যন্ত্র’ ছাড়া তেমন দৃশ্যমান কোনো বড় বাধা নেই। সেই হিসেবে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতি যে রকম দ্রুততালে হওয়ার কথা তা হচ্ছে কি? মন্ত্রী বাহাদুররা যা-ই বলুন, অর্থনীতি কিন্তু ‘আঁধারের পথযাত্রী’। মূল্যস্ফীতি লাগামছাড়া। দারিদ্র্য বাড়ছে। সীমান্তজুড়ে বৈরিতা। শিক্ষাব্যবস্থায় চরম অব্যবস্থা। গরিব কৃষকের অস্তিত্ব বিপন্ন। অবশ্য পরিকল্পনা কমিশনের দেয়ালে শোভা পাচ্ছে ‘সময় এখন আমাদের’। 

মহাভারতের অন্যতম প্রধান চরিত্র ভীষ্মদেব বলেছিলেন, ‘শাসক কখনো পরিস্থিতির ক্রীতদাস হবে না; বরং তার কর্মের মধ্যে দিয়ে পরিস্থিতি বদলে দেবেন।’ কিন্তু আমরা যেন কেবলই পরিস্থিতির দোহাই দিচ্ছি, অথবা শাসকদের ক্রীতদাসে পরিণত হচ্ছি! 
কোয়ালিশন সরকারে যা হয়, আর পাঁচটা দলের নেতাদের শর্ত মানতে মানতেই বেলা কেটে যায়। পদে পদে চলে শরিকদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত। এতে পণ্ড হয় কাজ। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আমাদের দেশে পরিস্থিতি ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেছে। আজ পেছন থেকে কোনো অন্তরাত্মা নয়, কোনো চতুর নেতা নয়, কোনো শরিক নেতার অঙ্গুলিহেলন নয়, গোটা দেশটাকে চালাচ্ছে এক অপরিসীম শক্তি—পিএমও। সংক্ষেপে প্রধানমন্ত্রীর অফিস। একটাই পোস্ট, বাকি সব মিছে! অধিকাংশ ক্যাবিনেট মন্ত্রীরও ক্ষমতা শূন্য। সরকার কীভাবে চলছে, মন্ত্রণালয় কী করবে, তা কেউ জানে না। সব জানে প্রধানমন্ত্রীর অফিস। সবকিছুতেই একটা জিনিস পরিষ্কার, সিদ্ধান্তটা একটা স্থান থেকেই উৎপন্ন। গণপ্রজাতান্ত্রিকতার যে আদর্শের ওপর বাংলাদেশের গণতন্ত্র দাঁড়িয়ে, যে সম্মিলিত সিদ্ধান্তের দর্শনের ওপর দাঁড়িয়ে মন্ত্রিপরিষদ পরিচালিত হয়, তা আজ অনুপস্থিত। মন্ত্রিসভার সিনিয়র সদস্য থেকে ধুরন্ধর আমলা, কারও বক্তব্যেরই কোনো দাম নেই। যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত সে অর্থনীতি কিংবা পররাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতিই হোক কিংবা কৃষিনীতি, সবই আসছে একটা কেন্দ্র থেকে। অনেক সিদ্ধান্তের ব্যাপারেই ক্যাবিনেট মন্ত্রীরা পর্যন্ত জানতে পারছেন তা কার্যকর হওয়ার পরে। কাগজে পড়ে। এখন পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে, সবাই সব সিদ্ধান্তের জন্য তীর্থের কাকের মতো একই দিকে তাকিয়ে থাকেন।  

তারপরও দেশটা সত্যি ভালো আছে, সবকিছু ঠিকঠাকমতো চলছে? অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষার পরিবেশ, সব ভালো চলছে তো? কী বলছে পরিসংখ্যান? যত বড় সরকার ভক্তই হোন না কেন, পাঁচ বছরে অর্থনীতি এগিয়েছে, সমৃদ্ধির বসন্ত শুরু হয়ে গেছে, এমন কথা বলার মতো মনের জোরওয়ালা লোক কজন পাওয়া যাবে?  

হ্যাঁ, দেশে কোটিপতির সংখ্যা, কোটিপতি ব্যাংক আমানতকারীর সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার চেয়ে বৈষম্য বেড়েছে অনেক বেশি। অনেকে মধ্যবিত্ত কৃষক থেকে গরিব কৃষকে পরিণত হয়েছেন। ভূমিহীন মানুষের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ছিন্নমূল, নদীভাঙা মানুষের শহরমুখী স্রোত কয়েক বছরে কতটা বেড়েছে, আয়বঞ্চনা ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে গরিব মানুষ খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারছে, সে খবর কে রাখে? এগুলোর কোনো বিশ্বাসযোগ্য পরিসংখ্যানও হয়তো নেই।

করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বে দেখা দিয়েছে মন্দার পরিস্থিতি। প্রায় সব দেশের অর্থনীতিই জোর ধাক্কা খেয়েছে। বাংলাদেশেও কর্মহীন হয়ে পড়েছেন কয়েক লাখ মানুষ। দিন আনা-দিন খাওয়া মানুষদের রোজগার কমেছে ভয়াবহ হারে। দৈনিক বেতনভুক নারী কর্মচারীদের রোজগারে ধাক্কা লেগেছে অপেক্ষাকৃত বেশি।  

অর্থনীতির দুর্যোগ কাটছে না। রিজার্ভ কমছে। জোড়াতালি দিয়ে চলছে রাষ্ট্রীয় লেনদেন। অর্থনীতির সামনে চ্যালেঞ্জ দূর হচ্ছে না। কিন্তু মন্ত্রী-আমলাদের কথায়-আচরণে তার কোনো প্রতিফলন নেই। অপব্যয়, দুর্নীতি কমানোর কোনো কঠোর অঙ্গীকার কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সরকারি চাকুরে বাদে আর কজনের আয়-রোজগার আগের মতো থাকবে, তা বলা মুশকিল। আর এর কারণ শুধু করোনা বা যুদ্ধ নয়। মহামারির আগে থেকেই দেশের আর্থিক বনিয়াদের ওপর ‘ম্যান মেড’ আঘাত নামিয়ে আনা হয়েছে। সিন্ডিকেট আছে, কিন্তু ভাঙার কেউ নেই।  

ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতির গুণকীর্তন শোনা যায়। কিন্তু কিছু উজাড় করে দিয়েও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খুব ‘মধুময়’ হয়েছে কি? তিস্তা পানি পাওয়া আর বুঝি হলো না। অভিন্ন নদীর পানির বণ্টন তো দূরের কথা, সীমান্ত হত্যা পর্যন্ত বন্ধ করা যায়নি। যতটুকু যা বাণিজ্য বাড়ছে, তা একপক্ষীয়। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান নিয়েও তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি হয়েছে, দেশে বাড়ছে বিপুল পরিমাণে চীনা বিনিয়োগ, কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার ব্যাপারে চীন-রাশিয়া বাংলাদেশের প্রস্তাব ও স্বার্থের বিপরীতেই হাঁটছে। পররাষ্ট্রনীতির এই অধ্যায়কে গৌরবোজ্জ্বল বলে সরকারের স্তুতি করা যায় কি? 
রুটি সেঁকার জন্য তাওয়া গরম করতে হয়। আবার সেই তাওয়া বেশি তেতে গেলে রুটি যায় পুড়ে। তখন খাবারের থালার বদলে রুটির জায়গা হয় ডাস্টবিনে। রাজনীতিতেও তেমনটাই। মানুষজনকে চাঙা করার জন্য নেতারা গরম-গরম ভাষণ দেন। কিন্তু তা মাত্রা ছাড়ালে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। পাতে তোলে না। বলতে বাধা নেই, কথায় ও কাজে মিল না থাকার কারণে ক্ষমতাসীনদের প্রতি ক্ষোভের মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে। নির্বাচনব্যবস্থা প্রহসনে পরিণত হওয়ার কারণে মানুষের এই ক্ষোভের হয়তো আপাতত প্রতিফলন নেই। কিন্তু শাসকদের তা বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। 

এদিকে দেশে বিরোধী দলের অস্তিত্ব যেন কোনো এক অন্ধকার গহ্বরে হারিয়ে গেছে। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় দল বিএনপিকে কিছু মিডিয়ায় ছাড়া এখন আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না। বিএনপি অবশ্য নিজের দোষেই এমন পরিণতি বরণ করেছে। জামায়াতের সঙ্গে মিলে বিএনপির হিংসাত্মক আন্দোলন দলটিকে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করে। এরপর ‘ফলাতক’ নেতৃত্ব দলটির প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বিএনপির আন্দোলন নেতা-নেত্রীদের হুমকি-ধমকিতেই সীমাবদ্ধ। অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে দলটি শোচনীয় রকম ব্যর্থ। প্রতিবাদ হিংসার পথ নিলে দিকভ্রষ্ট হয় আন্দোলন। তখন লক্ষ্যকে ছাপিয়ে বড় হয়ে যায় উপলক্ষ। এ কথা প্রমাণ হয়েছে বারবার। সাফল্যের কোনো শর্টকাট রুট নেই। সাফল্য আসে ধারাবাহিকতার হাত ধরে। ধারাবাহিক ও সংযত আন্দোলনেই পূরণ হয় উদ্দেশ্য। অবিরাম বৃষ্টিধারা মাটির একটার পর একটা স্তর ভেদ করে ধীরে ধীরে পৌঁছায় গভীরে। পুষ্ট করে ভূগর্ভস্থ জলাধার। সেই বিশুদ্ধ জলই মানুষের জীবন বাঁচায়। আন্দোলনও তেমনি। ধারাবাহিক আন্দোলন মানুষের মনের গভীরে জায়গা করে নেয়। সুরক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠার ভরসা জোগায়।

সে কাজটি বিএনপি করতে পারছে না। বিভিন্ন ছোটখাটো সভা-সমাবেশে বিএনপির নেতা-নেত্রীরা সরকারের বিরুদ্ধে একই মুখস্থ বুলি আওড়াচ্ছেন। একই হুমকি দিচ্ছেন। ‘আন্দোলনের মাধ্যমে’ ক্ষমতাসীনদের ‘সব দাবি মানতে বাধ্য করার’ ঘোষণা দিচ্ছেন। কিন্তু সেই আন্দোলন আর হচ্ছে না। গরম-গরম কথাই কেবল সার হচ্ছে। রাজনীতিতে গরম-গরম কথা, হিংসাত্মক আন্দোলন, কদর্য ভাষার প্রয়োগ দেউলিয়াপনার লক্ষণ। উসকানিমূলক ভাষণ ও ব্যক্তি আক্রমণে স্তাবকদের হাততালি পাওয়া যায়, কিন্তু সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নেয়। কারণ রাজনীতির চাওয়া-পাওয়ার বাইরে অসংখ্য মানুষ আছেন, যাঁরা শান্তি ছাড়া আর কিছুই চান না।

বড় হওয়ার সর্বোত্তম রাস্তা নিজের উৎকর্ষ বৃদ্ধি। অন্যকে ছোট করে বড় হওয়ার চেষ্টা ভুল এবং বিপজ্জনক। কিন্তু রাজনীতিতে দিন দিন সেটাই জনপ্রিয় হচ্ছে। সমালোচনা করলেই হেনস্তার চেষ্টা হচ্ছে। কম-বেশি সব দলেই এই প্রবণতা চলছে। 

একটা ‘অক্ষম বিরোধী দল’কে ছলে-বলে-কৌশলে দুর্বল বানিয়ে রাখার সাফল্য ক্ষমতাসীনেরা আর কতকাল উপভোগ করবে? বিরোধী দলই বা আর কত দিন নিজেদের মৌলিক মূর্খতার বৃত্তে ঘুরপাক খাবে?  

ইতিহাস শুধু কিছু অতীত ঘটনার সাক্ষীই নয়, শিক্ষাও দেয়। কী করা উচিত, আর কোনটা এড়িয়ে চলা দরকার, ইতিহাস সেই শিক্ষাও দেয়। সেই শিক্ষাটা কেউ নেবে কি না, সেটা অবশ্য নিতান্তই তাদের নিজস্ব ব্যাপার।

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     
    ভোটের মাঠে

    শেরপুর-৩: আ.লীগে কোন্দল, গোছানো বিএনপি

    গাজীপুরে কি তবে হলো নতুন যাত্রার শুরু

    ভয়কে জয় করে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশের উন্নতি

    ফুটবলে নতুন একটা জোয়ার আসুক

    নৈতিক অধঃপতনে সংস্কৃতির বিপর্যয়

    দ্বিজেন শর্মা প্রকৃতির পরম্পরা

    বাফুফেকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন সাফজয়ী ছোটন

    লক্ষ্মীপুরে ছাত্রলীগ নেতাকে গুলি করে হত্যা: ৮ জনের ফাঁসির রায়

    অনুষ্ঠানের দিন বাতিল নচিকেতার কনসার্ট, দর্শকদের বিক্ষোভ

    পাকিস্তানের হাইব্রিড মডেলে ভারতের আপত্তি