একটা সময় আমাদের দেশে যৌথ পরিবারে একসঙ্গে মিলেমিশে বাস করার সংস্কৃতি ছিল। শুধু পরিবার নয়, একসময় পাড়া-প্রতিবেশীরাও একে অপরের সুখে-দুঃখে পরস্পরের পাশে দাঁড়াতে কুণ্ঠাবোধ করত না। বিপদে-আপদে বাড়িয়ে দিত সাহায্য-সহযোগিতার হাত। এখন সময় বদলেছে। যৌথ পরিবারে ভাঙন ধরেছে। সামষ্টিক সমাজবোধের জায়গা দখল করেছে সংকীর্ণ স্বার্থচিন্তা। এখন সবাই নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।
কেন এ রকম অবস্থা হলো? পাড়া-প্রতিবেশী তো দূরের কথা, ভাইয়ে-ভাইয়েও এখন মিলমিশ সেভাবে দেখা যায় না। হৃদ্যতা ও সহানুভূতির পরিবর্তে বিদ্বেষ ও প্রতিহিংসাপরায়ণতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। ছোট ভাইয়ের প্রতি বড় ভাইয়ের মমত্ব দেখা যায় না, বড় ভাইকে ছোট ভাই শ্রদ্ধা করে না। লোভ-লালসা-হিংসার কারণে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহের বদলে বিবাদ, মনোমালিন্য হয়ে উঠছে স্বাভাবিক বিষয়।
আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত ‘একঘরে পরিবার, আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে এসএসসি’ শিরোনামে প্রকাশিত খবরে ভাইয়ে-ভাইয়ে বিরোধের যে চিত্র ফুটে উঠেছে, তা পীড়াদায়ক।
মানিকগঞ্জের দৌলতপুর উপজেলার আগকলিয়া এলাকার গ্রামের হানিফ কাজী তাঁর বাড়িতে লোহার গেট লাগিয়েছিলেন। এই গেটের কারণে ছোট ভাই বাতেন কাজী তাঁর অটোরিকশা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করাতে পারতেন না। এ জন্য কয়েকবার গেটটি সরিয়ে নিতে বললেও বড় ভাই তা সরাননি। হানিফ কাজীকে এ সমস্যার কথা বলা হলেও তা মাথায় নেননি। তাই বাতেন কাজী সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো উপায় না দেখে গ্রাম্য মাতবরদের কাছে বিচার চাইতে বাধ্য হন। সমস্যাটি সমাধানের জন্য মাতবরেরা সালিস ডাকেন। কিন্তু হানিফ ঢাকায় চাকরি করায় সালিসে উপস্থিত হতে পারেননি। ওই দিনের সালিস বৈঠকে মাতবরেরা হানিফের পরিবারকে একঘরে করে রাখার ঘোষণা জারি করেন। একই সঙ্গে সবাইকে ওই পরিবারের সঙ্গে মিশতে ও লেনদেন করতে নিষেধ করে দেওয়া হয়। এ ছাড়া হানিফের বাড়িটি বেড়া দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়, যখন হানিফের মেয়ের এসএসসি পরীক্ষা চলছে। এ রকম একটা অমানবিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে গ্রাম্য মাতবরেরা কি তাঁদের সিদ্ধান্তের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভেবেছিলেন? এরপর হানিফের পরিবার পাশের গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। কিন্তু কোনো সুরাহা না হওয়ায় হানিফ কাজীর স্ত্রী দৌলতপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে।
একসময় আমাদের দেশে বড় বড় অনেক পারিবারিক ও সামাজিক সমস্যা গ্রামের মাতবরেরা মিটিয়ে ফেলতেন। থানা, পুলিশ ও আদালত পর্যন্ত যেতে হতো না। এখন মাতবরদের প্রতি আস্থা কমেছে। আইন, আদালতের প্রতি আস্থা বেড়েছে। তবে আইনের সুবিধা যে সবাই সমানভাবে নিতে পারে না, তারই প্রমাণ দৌলতপুরের ঘটনাটি।
আমাদের সমাজে সামগ্রিকভাবে যে পচন ধরেছে, তা নিয়ে বিতর্কের সুযোগ নেই। তাই পারিবারিক বিরোধ-কলহ বড় সমস্যা হয়ে ওঠার আগেই তার মীমাংসার উপযুক্ত উপায় হলো—শিথিল হয়ে পড়া পারিবারিক বন্ধনকে আবার দৃঢ় করে তোলা।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে