বৃহস্পতিবার, ০৮ জুন ২০২৩

সেকশন

 

ট্রাম্প অভিযুক্ত হওয়া কি যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র ও আত্মমর্যাদায় বড় আঘাত

আপডেট : ৩১ মার্চ ২০২৩, ১৮:১২

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ছবি: এএফপি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ গঠন করা হবে কি হবে না, তা নিয়ে বেশ কয়েক দিন ধরে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক অঙ্গনে জল্পনা-কল্পনা চলছিল। শেষ পর্যন্ত ঘটনা ঘটেই গেল। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের এই সাবেক প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ গঠন করলেন ম্যানহাটনের গ্র্যান্ড জুরি আদালত। 

সাবেক পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মামলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গঠন করা হলো। স্টর্মির অভিযোগ, ২০০৬ সালের দিকে ট্রাম্পের সঙ্গে তাঁর যৌন সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক নিয়ে স্টর্মি যাতে মুখ না খোলেন, এ জন্য ২০১৬ সালের নির্বাচনের আগে ট্রাম্প তাঁকে বিপুল অঙ্কের ঘুষ দিয়েছিলেন। তবে ট্রাম্প নিজে তা দেননি, তাঁর সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেনের মাধ্যমে ১ লাখ ৩০ হাজার ডলার দিয়েছিলেন। 

স্টর্মির অভিযোগের ভিত্তিতে ট্রাম্পের বিরুদ্ধে তিনটি তদন্ত চলছিল। নিউইয়র্কের তদন্তকারীরাই বৃহস্পতিবার প্রথমবারের মতো তাঁদের সিদ্ধান্ত জানালেন। 

এতে কি ডেমোক্র্যাট ও ট্রাম্পবিরোধীরা আনন্দিত হবেন? বিশ্লেষকেরা বলছেন, অন্যের দুর্দশা দেখে উৎফুল্ল হওয়ার মতো ঘটনা এটি নয়। কারণ ট্রাম্প কোনো রাজনৈতিক অপরাধ ও অপকর্মের জন্য অভিযুক্ত হননি। তাঁর বিরুদ্ধে তিনটি তদন্ত চলছে। তার মধ্যে একটি তদন্তে অভিযোগ গঠন করা হলো। অন্য দুটি তদন্তেও তাঁকে হয়তো অভিযুক্ত করা হবে। তত দিন পর্যন্ত আনন্দ সিকেই তুলে রাখা ভালো। 

কেন এমনটি বলছেন বিশ্লেষকেরা? তাঁদের মতে, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যে ঘটনাটি ঘটল, তা যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যবাহী গণতন্ত্র ও সুমহান আত্মমর্যাদার ওপর চপেটাঘাত। এরই মধ্যে ট্রাম্পের কট্টর সমর্থক এলিস স্টেফানিক ও অ্যান্ডি বিগস অভিযোগ করে বলেছেন, দেশটা ক্রমশ কর্তৃত্ববাদী ও তৃতীয় বিশ্বের মতো হয়ে উঠছে। 

সাবেক পর্নো তারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলসের মামলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। ছবি: এএফপি তবে এখনই এজাতীয় ঢালাও মন্তব্য অবশ্য বিভ্রান্তিকর। যেমনটা বলেছেন দ্য গার্ডিয়ানের কলাম লেখক জ্যান-ওয়ার্নার মুলার। তিনি বলেছেন, এজাতীয় মন্তব্যের কারণে মনে হতে পারে যে বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের র‍্যাঙ্কিংয়ে তারা বুঝি বেশ ভালো! 

একটি বিষয় স্মরণ করা দরকার, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম কোনো প্রেসিডেন্ট ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলেন। তবে বিশ্বের ইতিহাসে এটি প্রথম নয়। 

জার্মানির সাবেক প্রেসিডেন্ট ক্রিশ্চিয়ান উলফকে ২০১৩ সালের এপ্রিলে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। ফ্রান্সের সাবেক প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি একজন বিচারককে ঘুষ দেওয়ার জন্য এবং প্রচারণার অর্থ লঙ্ঘনের জন্য দোষী সাব্যস্ত হয়ে তিন বছরের কারাদণ্ড পেয়েছেন। তাঁর আপিল এখনো বিচারাধীন। ইতালির ট্রাম্প হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রধানমন্ত্রী সিলভিও বারলুসকোনিকে দেশটির আদালত চার বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। 

এসব উদাহরণ দেখে মনে হতে পারে আইন সবার জন্য সমান। তবে শাস্তিও কি সবার জন্য সমান? অবশ্যই না। যেমন বয়সজনিত কারণে বারলুসকোনিকে কখনোই কারাবন্দী করা হয়নি। তাঁর শাস্তি সপ্তাহে চার ঘণ্টা করে ডিমেনশিয়া রোগীদের সঙ্গে কাজ করা। আবার নিকোলাস সারকোজির আপিল যদি খারিজ হয়ে যায়, তাহলে তাঁকে একটি ইলেকট্রনিক মনিটরিং ব্রেসলেটসহ গৃহবন্দী করা হতে পারে। বারলুসকোনির দিকে তাকান। তিনি আবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু করেছেন এবং ইতালির সিনেটে খুব স্বাচ্ছন্দ্যে বসে আছেন। 

তবে এসব ঘটনার মাধ্যমে প্রসিকিউশনের একটি সুস্পষ্ট বার্তা আছে বটে। সেটি হচ্ছে, রাজনীতিতে যোগ দেওয়া মানেই ন্যায়বিচার এড়ানোর সুযোগ নয়। বারলুসকোনিকে কয়েক বছর আইনি জটিলতায় ভুগতে হয়েছে। তিনি আশা করেছিলেন, সংসদীয় দায়মুক্তি তাঁকে আদালতের সাজা থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু জনপ্রিয় হওয়া ও নির্দোষ হওয়া এক জিনিস নয়, আদালত সেটিই বুঝিয়ে দিয়েছে। 

ট্রাম্পও হয়তো ভেবেছেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থিতা ঘোষণা করলে তাঁর অভিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমবে। 

ট্রাম্পের এ ধরনের অনুমান ভুল প্রমাণ করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তিনি ইতিমধ্যে গণতন্ত্রের জন্য বিপদ ডেকে এনেছেন। তিনি ‘প্রতিশোধ’ শব্দটিকে রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছেন। গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতাকে প্রতিশোধের বিষয়ে পরিণত করা খুবই বিপজ্জনক। ডেমোক্র্যাটরা এ ধরনের কাজ খুব একটা করেননি। 

প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষা ও অসন্তোষ রাজনৈতিক চুলোয় ঘি ঢালার মতো কাজ করে। ট্রাম্প গত নির্বাচনে হেরে যাওয়ার পর থেকে এ কাজ খুব সুচারুভাবে করছেন। এর মাধ্যমে তিনি লাভবানও হয়েছেন। বিশ্বজুড়ে কর্তৃত্ববাদী নেতারা এখন দেখছেন, অভিযোগে কাজ হয়। উসকানিতেও কাজ হয়। এর মাধ্যমে একশ্রেণির উন্মত্ত জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করা যায়। ‘ভিকটিম কার্ড’ খেলে সহানুভূতি অর্জন করা যায়। ট্রাম্প এখন যে ভিকটিম কার্ড খেলছেন, সেটি নিছক ‘হাস মানির’ গল্পটি চাপা দেওয়ার জন্য। 

২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ট্রাম্পের আহ্বানে তাঁর সমর্থকেরা ক্যাপিটল হিলে সহিংস তাণ্ডব চালিয়েছিল। ছবি: এএফপি যা হোক, ট্রাম্পের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অভিযোগ গঠনের এ ঘটনা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্রের আত্মবোধে আঘাত করার মতো একটি ঘটনা। বিবিসির বিশ্লেষক ও ওয়াশিংটন সংবাদদাতা গ্যারি ও’ডোনোগু বলেছেন, ট্রাম্পের অভিযুক্ত হওয়া শুধু তাঁর নিজের এবং রিপাবলিকান পার্টির জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং আমেরিকার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হলেন। 

গ্যারি আরও বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র অবশ্যই নিজেকে অন্যের চেয়ে আলাদা মনে করে। আমাদের মনে রাখা দরকার, ওয়াশিংটন শহরটি একটি পাহাড়ের ওপর অবস্থিত এবং এটি পাহাড়ের মতোই উঁচু জায়গা থেকে সারা বিশ্বে গণতন্ত্রের আলো ছড়ায়। সুতরাং ট্রাম্পের এ ঘটনা শুধু তাঁর জন্যই সমস্যাজনক নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক আত্মবোধের ওপরেও একটি বড় আঘাত। 

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ছবি: এএফপি যুক্তরাষ্ট্র এর আগে ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি গণতন্ত্রের ওপর বড় ধরনের আঘাত দেখেছে। ওই দিন ট্রাম্পের আহ্বানে তাঁর সমর্থকেরা ক্যাপিটল হিলে সহিংস তাণ্ডব চালিয়েছিল। এতে যুক্তরাষ্ট্রের বহুদিনের আত্মবোধ ও আত্মমর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়েছে। 

এখন একধরনের ভূরাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। একদিকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ, অন্যদিকে চীনের দৃঢ়তা যুক্তরাষ্ট্রকে কোণঠাসা করে ফেলেছে। এতে সারা বিশ্বের কাছেই যুক্তরাষ্ট্রের আত্মমর্যাদা হুমকির মুখে পড়েছে। এরই মধ্যে নিজ দেশে ট্রাম্পকে ঘিরে যা ঘটল, তাতে দেশটির আত্মমর্যাদা আরেকবার চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ল। 

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, বিবিসি, ডয়চে ভেলে ও রয়টার্স

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি: উগান্ডা, সোমালিয়া ও নাইজেরিয়ায় কেমন প্রভাব পড়ল

    এরদোয়ানের জয়ে চিন্তার ভাঁজ পশ্চিমাদের কপালে

    এরদোয়ানের জয়ে বিভক্ত তুরস্ক

    অপ্রতিরোধ্য এরদোয়ান: অন্তর্ভুক্তিমূলক নাকি আরও কঠোরতার পথে তুরস্ক

    মার্কিন ঋণ খেলাপে চীন ও জাপানের মাথাব্যথা কেন

    ইমরান খানের পিটিআই মৃত্যুশয্যায়, পাকিস্তানে গণতন্ত্র কত দূর

    ভোটের সময় হয়রানিমূলক কোনো মামলা নয়: সংসদে আইনমন্ত্রী

    ওয়ানডে দিয়ে ফেরার অপেক্ষায় সাকিব 

    সুন্দরবনে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরায় ১৮ জেলে আটক

    ঢাবির ব্যবসায় শিক্ষা ইউনিটে পাসের হার ১১.৮৪ শতাংশ

    পাবনায় বিএনপির নেতা কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ, হাবিবসহ আহত ১০ 

    দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাসে ১৮৫ ঘণ্টা পর অনশন ভাঙলেন জাবি শিক্ষার্থী