চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কয়েক মাস ধরে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সবশেষ প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, আবাসিক হলের প্রভোস্টসহ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ থেকে দুই দিনে পদত্যাগ করেছেন ১৯ জন শিক্ষক। এর মধ্যে প্রথম দফায় প্রক্টরসহ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ ১৮টি পদ থেকে ১৬ শিক্ষক একযোগে পদত্যাগ করেন। এর এক দিন পরই ৪টি পদ থেকে সরে দাঁড়ান আরও ৩ শিক্ষক। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে অর্থ লেনদেন নিয়ে পাঁচটি ফোনালাপ ফাঁস হয়। এসব ফোনালাপ ছিল উপাচার্য শিরীণ আখতারের ব্যক্তিগত সহকারী খালেদ মিছবাহুল ও হিসাব নিয়ামক দপ্তরের কর্মচারী আহমদ হোসেনের সঙ্গে দুজন নিয়োগপ্রার্থীর। খালেদ মিছবাহুল উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্বেও ছিলেন। বছরের শুরুর দিকেই ক্যাম্পাসে পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি পালন করেছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির দুই অংশ।
গত মঙ্গল ও বুধবার বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা জানা গেছে, মূলত উপাচার্যের খেয়ালখুশিমতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনাসহ নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, নিয়োগ-বাণিজ্য, শিক্ষকদের স্বার্থের দ্বন্দ্ব, শিক্ষক রাজনীতির নানা সমীকরণ এবং উপাচার্য পদ পাওয়ার লড়াইয়ের কারণেই পরিস্থিতির এমন অবনতি। অন্তত ১৫ জন শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী জানান, নিয়োগ-বাণিজ্য, দল ভারী করতে নিয়োগ এবং বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক একাধিক পক্ষের স্বার্থের দ্বন্দ্বে অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এর সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ এবং চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের একাধিক পক্ষ।
কয়েকজন শিক্ষকের অভিযোগ, প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে ‘অনভিজ্ঞ’ হওয়ায় উপাচার্য আইনের চেয়ে নিজের খেয়ালখুশিকেই বেশি প্রাধান্য দেন। উদাহরণ দিয়ে তাঁরা বলেন, ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের দুই শিক্ষক সহকারী অধ্যাপক হওয়ার পরও তাঁদের মধ্য থেকে একজনকে সভাপতি না করায় বিষয়টি আদালতে গড়ায়। উপাচার্য হওয়ার আগে উপ-উপাচার্যের দায়িত্ব পালন ছাড়া শিরীণ আখতার আগে আর কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন না।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকি আজকের পত্রিকাকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, এর জন্য দায়ী উপাচার্য। কারণ তিনি নিয়মের তোয়াক্কা না করে খেয়ালখুশিমতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন।
তবে শিক্ষক সমিতির সদস্য অধ্যাপক মো. ফরিদুল আলম বলেন, খেয়ালখুশিমতো বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার অভিযোগ সঠিক নয়। এমন অভিযোগ কারা, কেন, কিসের স্বার্থে করছেন তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর হাটহাজারী উপজেলায় যাত্রা শুরু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ৯টি অনুষদের অধীনে ৪৮টি বিভাগ ও ৬টি ইনস্টিটিউট আছে। এতে শিক্ষার্থী ২৭ হাজার ৫৫০ জন। আর শিক্ষক ৯০৬ জন এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ১ হাজার ৯৭৪ জন।
ইচ্ছেমতো শিক্ষক-নিয়োগ
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য প্রায় দুই বছরে ১৮৭ জন শিক্ষক ও কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে শিক্ষক ১১০ জন, কর্মচারী ৬৫ জন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে খণ্ডকালীন শিক্ষক ১২ জন। এসব নিয়োগ নিয়ে প্রতিবারই বিতর্ক উঠেছে, ফাঁস হয়েছে নিয়োগ-বাণিজ্যের ফোনালাপ।
অভিযোগ আছে, নিয়োগ দিতে নিয়মের তোয়াক্কা করেন না উপাচার্য। ইচ্ছেমতো নিয়োগ ও পদোন্নতি দিতে নিজের আস্থাভাজন শিক্ষকদের নিয়ে গঠন করেন সিলেকশন বোর্ড। নথিপত্র পর্যালোচনা করেও দেখা গেছে, এসব বোর্ডে অভিজ্ঞ ও জ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের রাখা হয়নি। কাউকে আবার একাধিক বোর্ডের সদস্য করা হয়েছে।
এ বিষয়ে সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক সিরাজ উদ দৌল্লাহ আজকের পত্রিকাকে বলেন, নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত নিয়মকানুন অনুসরণ করেন না উপাচার্য। ইচ্ছেমতো প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেন তিনি। এসব কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
জানা যায়, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে প্রভাষক নিয়োগে অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত ফোনালাপ ফাঁসের তদন্তে গঠিত কমিটি ১০টি সুপারিশ করেছিল। এতে ছিল অর্থের বিনিময়ে চাকরি প্রদানকারী চক্রকে খুঁজে বের করতে ফৌজদারি মামলা করার সুপারিশও। কিন্তু প্রায় আট মাসেও মামলা করেনি প্রশাসন।
নিয়োগ দিতে মরিয়া উপাচার্য
জানা যায়, দল ভারী করতে শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে মরিয়া উপাচার্য শিরীণ আখতার। এ জন্য তিনি নতুন ১২ বিভাগ ও ১টি ইনস্টিটিউট খোলার উদ্যোগ নিয়েছেন। তাঁর সময়ে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত পদের চেয়ে অতিরিক্ত ৩২ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৫৩৮তম সিন্ডিকেট সভায় অতিরিক্ত নিয়োগকে শুদ্ধাচার পরিপন্থী আখ্যা দিয়ে অতিরিক্ত নিয়োগ না দিতে বলা হয়েছে।
একজন শিক্ষক জানান, নিয়োগে বাণিজ্যও হয়। ফাঁস হওয়া ফোনালাপেই তা উঠে এসেছে।
সার্বিক বিষয়ে জানতে উপাচার্য শিরীণ আখতারের দপ্তরে গিয়েও তাঁকে পাওয়া যায়নি। কার্যালয় থেকে বলা হয়, উপাচার্য চট্টগ্রামের বাইরে আছেন। পরে একাধিকবার উপাচার্যকে ফোন ও এসএমএস করা হলেও সাড়া পাওয়া যায়নি।
পরে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে থাকা উপ-উপাচার্য (একাডেমিক) বেনু কুমার দে বলেন, নিয়োগ বোর্ডের সুপারিশ মেনেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কারও কোনো আপত্তি থাকলে নোট অব ডিসেন্ট দিলে সিন্ডিকেট সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে।
উপাচার্যের মেয়াদ নিয়ে ধোঁয়াশা
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট অনুযায়ী উপাচার্যের মেয়াদ চার বছর। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্যের নিয়োগপত্রে মেয়াদ উল্লেখ করা হয়নি। ২০১৯ সালের ৩ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা পরিপত্রে বলা হয়, সিনেটের নির্বাচিত প্যানেল থেকে নিয়মিত উপাচার্য নিয়োগ অথবা পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিয়োগ বলবৎ থাকবে। উপাচার্য পদে শিরীণ আখতার সাড়ে তিন বছরের বেশি কাটিয়েছেন। এখনো সিনেটের মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগের কোনো উদ্যোগই নেই। বর্তমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতির এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন একাধিক শিক্ষক।
ওই শিক্ষকদের মতে, নিয়োগে মেয়াদ উল্লেখ না থাকায় বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক একাধিক পক্ষ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চায়, যাতে উপাচার্য পদে পরিবর্তন আসে।
শিক্ষকদের দল-উপদল
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রাজনীতি দুই ধারায় বিভক্ত। এক ধারায় আওয়ামী লীগ ও বামপন্থী শিক্ষকেরা (হলুদ দল), অন্য ধারায় বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকেরা (সাদা)। হলুদ অংশে আবার দুটি পক্ষ—একটি উপাচার্যবিরোধী, অন্যটি উপাচার্যপন্থী। শিক্ষক সমিতি, ডিন ও সিন্ডিকেট নির্বাচনে দুটি অংশই আলাদা প্যানেলে অংশ নিয়েছে।
শিক্ষক সমিতির এক সদস্য বলেন, শিক্ষক রাজনীতির মূলে উপাচার্য পদের লড়াই। অনেকেই চাইছে, অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সুযোগে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে। এ ছাড়া এতে আঞ্চলিক রাজনীতির প্রভাবও আছে। তাঁর মতে, চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ দুই ধারা—একদিকে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন, অন্যদিকে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। এর প্রভাব আছে বিশ্ববিদ্যালয়ে।
স্বার্থের দ্বন্দ্বে পদত্যাগ
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন থেকে সম্প্রতি প্রক্টর, সহকারী প্রক্টর, প্রাধ্যক্ষসহ ১৯ জন শিক্ষক পদত্যাগ করেছেন। উপাচার্যের সঙ্গে স্বার্থের দ্বন্দ্বে তাঁরা পদত্যাগ করেছেন বলে পরস্পরের বক্তব্যে উঠে এসেছে। উপাচার্য গণমাধ্যমে দাবি করেন, অন্যায্য আবদার না রাখায় বেকায়দায় ফেলতে তৎকালীন প্রক্টরসহ সবাই পদত্যাগ করেছেন। অন্যদিকে পদত্যাগকারী কয়েকজনের দাবি, উপাচার্য বিভিন্ন নির্বাচনে তাঁর অনুসারীদের ভোট দিতে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তা পালনে ব্যর্থ হওয়ায় তাঁরা পদত্যাগ করেছেন।
স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে একযোগে পদত্যাগের ঘটনা ঘটেছে বলে মনে করেন ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডিন অধ্যাপক মো. হেলাল উদ্দিন নিজামী। তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, যাঁরা পদত্যাগ করেছেন, বিশেষ করে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা, তাঁরা উপাচার্যের সাড়ে তিন বছরের সকল দুষ্কর্মের অংশীদার। তাঁরা বর্তমানে উপাচার্যের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাতের কারণেই পদত্যাগ করেছেন।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে