শনিবার, ১০ জুন ২০২৩

সেকশন

 

স্বাধীনতার কড়চা

আপডেট : ২৪ মার্চ ২০২৩, ০৯:৫৯

যুদ্ধ শেষের বিজয় উল্লাস। ছবি: সংগৃহীত আমাদের এই ভূখণ্ডের মানুষই ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায়ে ভোট দিয়েছিল। তাদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা জুড়ে ছিল নতুন রাষ্ট্রে তাদের অধিকার-মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত হবে, স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। পূর্ব বাংলার মুসলিমরা তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করেছিল। তাদের যে পাঞ্জাবি দুঃশাসনের কবলে পড়তে হবে, নতুনভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের জাঁতাকলে পড়তে হবে, এটি তারা কল্পনাও করেনি। দেশভাগে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশদের পরিবর্তে হিন্দু-মুসলমান পরস্পরের প্রতিপক্ষ ও শত্রুতে পরিণত হয়ে পড়েছিল। ছিচল্লিশে কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সৃষ্টিমূলে ছিল মুসলিম লীগের ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে’ পালন, যার নেতৃত্বে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কলকাতার ওই দাঙ্গা ক্রমে বাংলাসহ বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনিবার্য করে তোলে দেশভাগ।

ব্রিটিশ বিদায়ে ক্ষমতার ভাগাভাগির প্রধান দুই কুশীলব কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ দেশভাগের রাজনৈতিক পাশার চালে ভুল করেনি। দল দুটির ক্ষমতার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে বাংলার দুই সম্প্রদায়ের মধ্যবিত্ত শ্রেণি যথাযথ ভূমিকা পালন করেছিল। অবিভক্ত বাংলার মোট জনসংখ্যার ৫২ শতাংশ মুসলিম এবং ৪৮ শতাংশ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়। নগণ্য সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘুর টানাপোড়েন হিন্দু মধ্যবিত্তের মনস্তাত্ত্বিক পীড়ন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির অগ্রণী ভূমিকাতেই বাংলাভাগ রোধ করা সম্ভব হয়নি। বাংলাভাগে বাঙালি হিন্দু-মুসলিম মধ্যবিত্তের শ্রেণি আকাঙ্ক্ষাও প্রধান হয়ে দাঁড়িয়েছিল। শ্রেণিস্বার্থে পরস্পর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দেশভাগের পথ মসৃণ করে তুলেছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ হিন্দু-মুসলিম ছিল দুই পক্ষের উসকে দেওয়া বিভাজনের বলির পাঁঠা।

শিক্ষা,  সংস্কৃতি,  অর্থবিত্তে,  সম্পদে,  জ্ঞানে,  জমি-জমিদারিতে,  ব্যবসা-বাণিজ্যে অগ্রসর হিন্দু সম্প্রদায়ের চেয়ে বিকাশমান বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণি ছিল পিছিয়ে। যোগ্যতায় কুলাবে না অগ্রসর হিন্দুদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উন্নতির শিখরে ওঠা। দেশভাগে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন অবস্থার সুযোগে নিজেদের শ্রেণি উত্তরণের পথ নিষ্কণ্টক ভেবে বসে। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হওয়ার ভয়ে ভীত হয়েই দেশভাগের আওয়াজ তুলেছিল। অথচ দেশভাগে পূর্ব বাংলার হিন্দু কিংবা পশ্চিম বাংলার মুসলমানের কী পরিণতি ঘটবে, তা কারও চিন্তায়ও আসেনি। চূড়ান্তে রক্তাক্ত দেশভাগ সম্পন্ন হয়েছে উচ্ছেদ, বিচ্ছেদ,  উৎপাটনের মর্মান্তিক পরিণতির মধ্য দিয়ে। পূর্ব বাংলা দুই হাজার মাইল দূরত্বের পাকিস্তান রাষ্ট্রে যুক্ত হয়ে যায়। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলাকে হতে হয় দিল্লির এককেন্দ্রিক শাসনের অধীন।

পাকিস্তান রাষ্ট্রে যুক্ত পূর্ব বাংলার মানুষের মোহভঙ্গ হতে বিলম্ব ঘটেনি। পাকিস্তান আন্দোলনের নেতারা মুসলিম লীগ সরকারের অগণতান্ত্রিক ও বাঙালিবিদ্বেষী আচরণ এবং বৈষম্যপূর্ণ কর্মকাণ্ডে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক বছর অতিক্রান্তে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে তরুণ নেতা শেখ মুজিবসহ অন্যদের উদ্যোগে গঠন করা হয় প্রদেশের প্রথম বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ। তখনকার পরিস্থিতির কারণে ‘মুসলিম’ শব্দটি যুক্ত করলেও পরে সেটা পরিহার করে নামকরণ করা হয় আওয়ামী লীগ।

পাকিস্তান রাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশের ভাষা উর্দু ছিল না। অথচ ভারত প্রত্যাগত উর্দুভাষী পুঁজিপতি শ্রেণির ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা হয়। পূর্ব বাংলার বাঙালিদের মাতৃভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষাকে স্বৈরতান্ত্রিক পন্থায় চাপানোর চেষ্টা চালায়। উর্দু ভাষাকে চাপানোর পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটে। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করে। ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ঘটে। প্রদেশের ক্ষমতা লাভ করে যুক্তফ্রন্ট সরকার। কিন্তু দ্রুতই যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করে পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকার। আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল এবং পর্যায়ক্রমে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন,  উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে স্বাধিকার-স্বাধীনতাসংগ্রামের অভিমুখে নিয়ে যায়।

সত্তরের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ২৫ মার্চ ১৯৭১ অপারেশন সার্চলাইট নামক গণহত্যা শুরু করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। নিরস্ত্র বাঙালি নিধন অভিযানের মুখে দৃঢ় প্রত্যয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় যৌথ বাহিনী নিঃশর্ত আত্মসমর্পণে বাধ্য করে বিশ্বের চৌকস সেনাবাহিনীখ্যাত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে। এই দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে জাতীয়তাবাদীরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিলেন বাম প্রগতিশীল সমাজতন্ত্রীরাও। তাঁদের মিলিত সংগ্রামে,  বীরত্বে, ত্যাগ-আত্মত্যাগে একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বর আমরা বিজয় লাভ করি। অর্জিত হয় স্বাধীনতা। এই বিজয়ে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের কাছে পরাস্ত ও পরাজিত হয় ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ।

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী মুজিবনগর সরকার ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের তিন প্রধান ভিত্তি—গণতন্ত্র,  সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। স্বাধীনতার পর বাহাত্তরে সংবিধান প্রণয়নকালে এর সঙ্গে যুক্ত করা হয় জাতীয়তাবাদ। সাংবিধানিক উপায়ে চার মূলনীতি থেকে সমাজতন্ত্রকে বিদায় করেছিল সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান। অপর সামরিক শাসক এরশাদ এক ফরমানবলে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাতিল করে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম প্রবর্তন করেছিল। বর্তমান সরকারও রাষ্ট্রধর্ম ইসলামকে সংবিধান থেকে বাদ দেয়নি। আর জাতীয়তাবাদ এখন ভাষা ছেড়ে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের অভিমুখে। স্বাধীন দেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করলেও এর প্রত্যাবর্তন ঘটেছে অধিক শক্তিমত্তায়। ভোটের রাজনীতিতে আমাদের শাসক দলগুলো তাদের নিয়ামক বলেই গণ্য করে। তাদের সঙ্গে আপস করে,  ক্ষমতার অংশীদার করে। তাদের পক্ষে রাখতে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক চেতনা বিনাশে পর্যন্ত দ্বিধা-সংকোচ করা হয় না। আর গণতন্ত্র! গণতন্ত্র মানেই ভোটতন্ত্র। এ ছাড়া গণতন্ত্র নামে থাকলেও কাজে থাকে না। আমাদের সামরিক-বেসামরিক কোনো শাসকের শাসনামলেই গণতন্ত্রের অবস্থা শক্তিশালী হয়নি। আমাদের সব শাসক নিজেদের জাতীয়তাবাদী দাবি করেন। এই জাতীয়তাবাদীদের শাসনামলে গণতন্ত্র কখনো প্রতিষ্ঠা পায়নি এবং নিরাপদও ছিল না, আজও নেই। স্বাধীন দেশে সব সরকারের আমলেই কর্তৃত্ববাদী শাসন প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। প্রকৃত গণতন্ত্রের নাগাল দেশবাসী কখনো পায়নি।

অধিক ত্যাগ ও আত্মদানে আমাদের স্বাধীনতা এসেছে। আমাদের জাতীয়তাবাদীরা ক্ষমতাপ্রাপ্তিকেই প্রধান অর্জন বিবেচনা করে শাসকের আসনে বসেছে। কিন্তু সব মানুষের স্বাধীনতা,  অধিকার,  সুযোগের সমতা প্রতিষ্ঠার বিপরীতে জনগণকে অধীনস্থ প্রজা হিসেবেই গণ্য করে এসেছে। তাই স্বাধীন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ স্বাধীনতাবঞ্চিত, অধিকারহারা। স্বাধীন দেশের শাসকের চরিত্র অতীতের শাসকদেরই যেন অবিকল নকল। রাষ্ট্রও তার সাবেকি চেহারা-চরিত্র নিয়ে বহালতবিয়তে রয়েছে। দেশের সংবিধানে রাষ্ট্রের মালিক জনগণ। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে, রাষ্ট্রের চরম প্রতিপক্ষ জনগণ। আমাদের দুর্ভাগ্য, স্বাধীন দেশে পরাধীন রাষ্ট্রব্যবস্থার বদল ঘটল না। সমাজ তো রাষ্ট্রেরই অধীন। তাই সমাজও বদলায়নি।

স্বাধীনতার অর্জন নিশ্চয় আছে। পরিমাণে নগণ্য হলেও। কিন্তু সবার ন্যায্যতা সমান না হলে হতাশা-ক্ষোভ জাগবে, পাশাপাশি জাগরণও ঘটবে। এই ভূখণ্ডের মানুষই তো সর্বোচ্চ ত্যাগে ব্রিটিশ পাকিস্তানিদের বিতাড়িত করেছে। স্বদেশি কর্তৃত্ববাদী,  ফ্যাসিবাদী শাসন-শোষণ চিরকাল নিশ্চয়ই দেশবাসী হজম করবে না। ধর্মভিত্তিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদ দুটির কোনোটি আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তি নিশ্চিত করতে পারেনি। গণতন্ত্র,  সমাজতন্ত্র,  ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে সব মানুষের স্বাধীনতা, অধিকার ও সুযোগের সমতা নিশ্চিত হলেই স্বাধীনতা ও মুক্তি নিশ্চিত হবে। তার আগে নয়।

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    পঠিতসর্বশেষ

    এলাকার খবর

     
     
    ইসলাম

    সময়মতো নামাজ পড়ার গুরুত্ব

    ভোটের মাঠে

    কক্সবাজার-৩: ভোটের লড়াই আত্মীয়ে-আত্মীয়ে

    বিজেপির অখণ্ড ভারত গঠনের স্বপ্ন পূরণ হবে কি

    বরিশাল সিটি নির্বাচনে হাতপাখার বড় মিছিল বাইরের মানুষে!

    জ্বালানি-সংকট: সাময়িক সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত

    কয়েক ছত্র

    অলস দুপুরে কৃষকের আড্ডায়

    বিমানবন্দরে ভারতীয় নারীর ট্রলিব্যাগে পাওয়া গেল ১২ কোটি টাকার কোকেন

    নাটোরে হাসপাতাল থেকে চুরি নবজাতক বিক্রি কুষ্টিয়ায়, পরে উদ্ধার

    শ্যামপুর থেকে মাদক মামলার সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামি আটক

    সিটি নির্বাচন

    রাজশাহীতে কাউন্সিলর প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্পে আগুন দেওয়ার অভিযোগ

    খুলনা সিটি নির্বাচন: আ.লীগের বিরুদ্ধে মধুর অভিযোগ মুখে মুখে, বলছে প্রতিপক্ষরা 

    ইন্টারনেট ব্যবহারই ৮৬ শতাংশ তরুণ শিক্ষার্থীর মানসিক সমস্যার কারণ: সমীক্ষা