শনিবার, ১০ জুন ২০২৩

সেকশন

 

স্মৃতিতে মার্চ ১৯৭১

আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৩, ১৩:১৩

স্মৃতিতে মার্চ ১৯৭১ আমার ক্লাস নাইনের পরীক্ষা শেষ, ক্লাস টেনের ক্লাস শুরু হয়েছে কেবল। এ রকম একটা সময় ছিল ১৯৭১ সালের ১ মার্চ। ১৯৭১ সালের ১ মার্চ যে জায়গা থেকে সারা ঢাকা শহর উত্তাল হলো, সেখানে আমার থাকার কথা না। কিন্তু ঘটনাক্রমে আমি সে জায়গাটাতেই ছিলাম। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে যাওয়ার জন্য, বাসা থেকে কিছুটা হেঁটে এসে, রামপুরা-সদরঘাট রুটে একটা ভাঙাচোরা বাসে উঠতে হতো। সেদিনও সেই বাসে উঠেই আমি কলেজিয়েট স্কুলের দিকে যাচ্ছিলাম। যাত্রাপথে তখন ঢাকার একমাত্র স্টেডিয়াম। কোনো ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল, তার সাজসজ্জা বাইরে। খেলা দেখার আমার কোনো পূর্বপরিকল্পনাও ছিল না, কিন্তু মনে হয় স্কুলে যাওয়ার চেয়ে খেলা দেখাটাই আমাকে বেশি টানল। আমি স্কুলে না গিয়ে বাস থেকে নেমে স্টেডিয়ামে ঢুকলাম খেলা দেখার জন্য।

পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের ক্রিকেট খেলা ছিল সেদিন। আমি যখন গ্যালারিতে বসলাম, তখন খেলা চলছে, পাকিস্তানের হানিফ মোহাম্মদ নামে একজন খুবই জনপ্রিয় ক্রিকেটার ছিলেন। ছয় ও চার পেটানোর জন্য তাঁর খুব খ্যাতি ছিল, আর ছিলেন ইন্তেখাব আলম। সম্ভবত হানিফ মোহাম্মদ বা ইন্তেখাব আলম তখন ব্যাটিং করছেন। ছয় ও চার হচ্ছে। সারা মাঠে উল্লাস, পাকিস্তান টিমের পক্ষে। খুবই উৎসবমুখর একটা পরিবেশ। আমার ঠিক পেছনে এক লোকের কাছে রেডিও বাজছে। খেলা দেখার সঙ্গে সঙ্গে রেডিওতে খেলার ধারাবিবরণী শুনছেন তিনি, খুবই সিরিয়াস দর্শক মনে হলো তাঁকে। সেই রেডিওর ধারাবিবরণীতে ১২টার খবরের বিরতি। তখনই মোড় ঘুরে গেল।

সেই খবরেই জানানো হলো, ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেছেন। এই খবরের সময় ঢাকার সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষের সমাবেশ ছিল ওই স্টেডিয়ামেই। শুনলাম, কিন্তু এর কী পরিণতি, কী তার তাৎপর্য, সেসব তখন আমার মাথায় নেই। কিন্তু ১০-১৫ মিনিটের মাথায় প্যান্ডেলের উল্টোদিকে দেখলাম আগুন। কিছুক্ষণের মধ্যে আগুনটা আরও ছড়াল। সবার মধ্যে সাংঘাতিক অস্থিরতা। কিছুক্ষণ আগে যে টিমের জন্য পুরো স্টেডিয়ামের মানুষ উল্লসিত ছিলেন, কিংবা তাঁদের সমর্থনে স্লোগান, হইচই নানা কিছু করছিলেন, সেই টিমের খেলোয়াড়দের দেখলাম তাঁরা তাড়া করছেন। খেলোয়াড়েরা দৌড়াচ্ছেন, পেছনে দর্শকেরা দৌড়াচ্ছেন, ভালোবেসে নয়, মার দেওয়ার জন্য।

পুরো মাঠ বদলে গেছে। কিসের খেলা, কিসের পাকিস্তান? তখন সরাসরি স্লোগান হচ্ছে ‘বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। প্যান্ডেল ছিঁড়ে, বাঁশটাশ খুলেটুলে, আগুনটাগুন লাগিয়ে ওখান থেকেই মিছিল শুরু হলো। স্টেডিয়ামে যাঁরা এতক্ষণ ছিলেন ক্রিকেট খেলার দর্শক, তাঁরাই হয়ে গেলেন মিছিলের প্রধান শক্তি। যেহেতু এত লোক ওখানে ছিল; সুতরাং বড় মিছিল শুরু হলো। জনতার মিছিল ঢাকা শহরে ঢুকল, দ্রুতবেগে ছুটতে থাকল। তারপর হয়তো যোগ হলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। আমিও যাচ্ছি মিছিলের সঙ্গে সঙ্গে। আজ আর বলতে পারব না মিছিল কোথায় কোথায় গিয়েছিল। সারা দিন কাঁধে একটা বাঁশ নিয়ে কোথায় কোথায় গেলাম, সেটা মনে নেই। যখন বাসায় ফিরলাম তখন সন্ধ্যা, কাঁধে সেই বাঁশ। বাসায় রাশভারী বাবার মুখেও দুশ্চিন্তার ছাপ। সারা ঢাকা শহর সেদিন ছিল মিছিলের শহর। প্রতিবাদের শহর। কারণ, সংসদ অধিবেশনের তারিখ পেছাতে পেছাতে, সর্বশেষ এই পেছানোর মধ্য দিয়ে, জেনারেল ইয়াহিয়া সরকার একটা অবস্থান পরিষ্কার করেছে যে তারা ক্ষমতা হস্তান্তর করতে চায় না।

১ মার্চ, ২ মার্চ এবং তারপর ক্রমান্বয়ে পরিস্থিতি এমন হলো যে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমান তখন সব তৎপরতার কেন্দ্রে। শেখ মুজিবুর রহমান তখন একক নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের প্রধান হিসেবে এটা তাঁর সাংবিধানিক এখতিয়ারও বটে। পাশাপাশি অন্যান্য নেতা ও দলও স্বাধীনতার সমর্থনে দাঁড়াল। যেমন মওলানা ভাসানী, মণি সিংহ, সেই সময় সিরাজ সিকদারও পরিচিত হচ্ছেন, বিশেষ করে বামপন্থীদের মধ্যে, তাঁরা সবাই ১ মার্চের পর সমর্থন দিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগকে। সিরাজ সিকদার সেই সময় লিফলেট দিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন, সর্বদলীয় কমিটি গঠন করেন এবং এখন স্বাধীনতাসংগ্রামই হচ্ছে প্রধান কাজ।

সাতই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিব স্বাধীনতার ঘোষণা দেবেন—এ রকমই আমরা শুনতে পাচ্ছিলাম। সেই ঘোষণার জন্য সাতই মার্চের জনসভার দিকে সবাই তাকিয়ে আছে। আমিও তখন সাতই মার্চের জনসভায় যেতে চাই, সে রকম আগ্রহ প্রকাশের পর আব্বাসহ বড় যাঁরা ছিলেন, তাঁরা মোটেই যেতে দিতে রাজি হলেন না এবং যাতে যেতে না পারি, সেটা নিশ্চিত করলেন। যেতে পারলাম না। কথা ছিল রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করা হবে শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ। শেষ মুহূর্তে রেডিও থেকে ঘোষণা হলো, এটা সম্প্রচার করা হবে না। তারপর রেডিওতে বা অন্যান্য জায়গায় সাংঘাতিক প্রতিক্রিয়া হয়েছে, আমরা পরে জেনেছি। রেডিও পরে রেকর্ডকৃত ভাষণ প্রচার করেছে ৮ মার্চ সকালে। আমাদের বাসায় একটা ফিতা ঘোরানো টেপ রেকর্ডার ছিল, মনে আছে আমি এবং আমার ভাইয়েরা মিলে ওই টেপ রেকর্ডারে বক্তৃতাটা রেকর্ড করেছিলাম। সেপ্টেম্বরের দিকে সামরিক বাহিনী যখন পাড়ায় বিভিন্ন বাসায় হামলা করছে, সে সময় আমার বড় বোন ওই ফিতা নষ্ট করে ফেলেন। সেই পর্যন্তও ছিল পুরো ভাষণটি।

মার্চের প্রথম থেকেই পাড়ায় পাড়ায় লড়াইয়ের নানা রকম প্রস্তুতি চলছিল। আমাদের পাড়ায় পল্লীমা সংসদ দুই বছর বয়সী ছোট সংগঠন, সেখানেও এগুলো নিয়ে কথাবার্তাই তখন প্রধান। শেখ মুজিবুর রহমান বারবার বলেছেন, অহিংস পথে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করতে হবে। তর্ক-বিতর্ক ছিল অহিংস পথে স্বাধীনতা আদৌ সম্ভব কি না। সশস্ত্র পথে হবে কি না, সশস্ত্র পথে হলে কীভাবে লড়াই হবে, আওয়ামী লীগ আদৌ প্রস্তুত কি না। এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক হচ্ছে, আমার বা আমার মতো আরও অনেকের এগুলো নিয়ে জানা-বোঝা খুবই কম। তা সত্ত্বেও, পরিস্থিতির কারণেই আগ্রহ ক্রমাগত বাড়ছে, জানা-বোঝার চেষ্টাও।

২৫ মার্চ রাতে যে ভয়ংকর পর্ব শুরু হলো তার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা এই অঞ্চলের মানুষের ছিল না। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা থেকেই পাড়ায় আমাদের বয়সীদের মধ্যে কিংবা সিনিয়রদের মধ্যে রাতের সম্ভাব্য হামলা নিয়ে উত্তেজনা ছিল। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল, এই হামলা মোকাবিলা করতে হবে। সুতরাং প্রস্তুতি নিতে হবে।

প্রস্তুতি তো শত্রু সম্পর্কে ধারণার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। শত্রুপক্ষ কোন মাত্রায় আক্রমণ করবে, সে সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না আমাদের।

আমাদের যাঁরা সিনিয়র ভাই ছিলেন, যাঁরা আমাদের গাইড করছেন, তাঁরা তখন বলছেন যে ব্যারিকেড দিতে হবে, যার যা অস্ত্র আছে তা নিয়েই রেডি থাকতে হবে। মনে আছে, সন্ধ্যা ৬-৭টার সময় আমাদের ব্যারিকেড করা শুরু হলো। ব্যারিকেড মানে—আমাদের দৌড় আর কত দূর তখন? বাঁশটাশ যা আছে তার সঙ্গে ইট, পাইপ ইত্যাদি জড়ো করে রাস্তার মধ্যে দাঁড় করানো হলো, সেই রাস্তার নাম এখন শহীদ বাকী সড়ক। এই বাকী আমাদের পাড়ারই বড় ভাই, ১৯৭১ সালের শহীদ। এই রাস্তাটার ওপরেই আমরা ব্যারিকেড দিলাম। রাতে যদি অ্যাটাক হয় কে কী করবে, সে নিয়ে আমাদের আগাম চিন্তা ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছিল। কার কী ভূমিকা থাকবে, সেটাও ঠিক করা ছিল। কেউ ছাদ থেকে ঢিল মারবে, কেউ গরম পানি ফেলবে, কেউ এদিক থেকে হুইসেল দেবে। আমার ও আমার বড় ভাইয়ের ওপর প্রথম দায়িত্ব ছিল, আনসার হেডকোয়ার্টার্স থেকে জোগাড় করা ছোট সাইরেন মেশিন দিয়ে ঘুরে ঘুরে সবাইকে জানাতে হবে যে আক্রমণ শুরু হয়েছে। সাড়ে ১০-১১টার পরে যখন গোলাগুলি বেড়ে গেল, তখন বোঝাই যাচ্ছিল সামরিক বাহিনী আক্রমণ করেছে। কাজেই সম্মিলিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, সাইরেন মেশিন নিয়ে আমরা দুজন বের হলাম সবাইকে জানানোর জন্য যে আক্রমণ শুরু হয়েছে।

আসলে সাইরেন দেওয়াটা অর্থহীন ছিল, কারণ ততক্ষণে প্রচণ্ড আওয়াজ শুরু হয়েছে। সাইরেন দিয়ে কাউকে জানানোর দরকার ছিল না যে আক্রমণ হচ্ছে। এই মাত্রার ভয়াবহ আক্রমণ আসলে আমাদের কারও হিসাবের মধ্যেই ছিল না। কিছুক্ষণ যেতে যেতে সাইরেন দেওয়ার পর বুঝলাম আমরা আর অগ্রসর হতে পারছি না। ফিরে আসার চেষ্টা করছি, ফিরেও আসা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছিল, পাশেই যেন ভয়ংকর মাত্রায় গুলি হচ্ছে বা বোমা ফুটছে। আমরা কেউই জীবনে কোনো দিন এ রকম আওয়াজ শুনিনি। সেই রাস্তার মধ্যেই আমরা দেখলাম ছাত্রনেতা দেলোয়ার হোসেন পারভেজ অন্ধকারে ফেরত আসছেন, তাঁর হাতে একটা রাইফেল। তিনি রাইফেল নিয়ে যাচ্ছিলেন প্রতিরোধ করার চেষ্টায়। তিনি স্বাধীনতার পরে মারা গিয়েছিলেন। এসবই তখন অসম্ভব একটা ব্যাপার, তবু এসব চিন্তা ও চেষ্টার গুরুত্ব কোনো অংশে কম নয়, এগুলোই পুরো দেশকে লড়াইয়ে দাঁড়ানোর জন্য প্রস্তুত করেছিল।

দেয়াল টপকে, বিভিন্ন বাড়ির ভেতর দিয়ে ঘরে ফিরলাম। আতঙ্কিত সবাই। ২৫ মার্চ সেই রাতে ঢাকা শহরে কেউ ঘুমাতে পারেনি। সবার মতো আমরাও একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে সেই রাত পার করলাম। ২৬ মার্চও তাই, দিবারাত্রি কারফিউ চলছিল। ২৭ মার্চ সকালবেলা যখন কারফিউ একটু সময়ের জন্য শিথিল হলো, সেই সময় আমরা দেখলাম ঢাকা শহরের মানুষের দলে দলে আতঙ্কিত যাত্রা। শুনলাম রাজারবাগ পুলিশ লাইনস, পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিভিন্ন বস্তিতে ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড হয়েছে। সেই দিন আমরা রাস্তায় দেখছি মানুষ যাচ্ছে স্রোতের মতো, সেই মানুষজনের মুখেই শুনলাম, ‘খবর আসছে আর কোনো অসুবিধা নেই বাঙালি আর্মিরাও আমাদের সঙ্গে জয়েন করছে। যুদ্ধ শুরু হইছে।’

আনু মুহাম্মদ, অর্থনীতিবিদ

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    ৫২ কোটি খরচ হলেও সংকেত নেই বাতির

    সচিবালয়ে এক ভবনেই ২৪০০ টন এসি

    সিটি নির্বাচনে বিএনপির হার্ডলাইন কিসের ইঙ্গিত

    ব্যাগেজ বিধিমালা: সোনার বার এনে মাশুল হাজারো প্রবাসীর

    বাজেটে মানব মর্যাদার বিষয়টি উপেক্ষিত

    উন্মুক্ত বিদ্যা আবশ্যক

    ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি পেল জামায়াত

    ফ্রান্সে ছুরি হামলার ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রে এখন ‘ব্যাকপ্যাক হিরো’

    পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে আ.লীগের মনোনয়ন পেলেন যারা

    বহিষ্কৃত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করলে ব্যবস্থা, বিএনপির মনিটরিং সেল গঠন

    বিএনপির সঙ্গে সংলাপের আশার প্রদীপ নিভে যায়নি: কাদের

    অপাত্রে ভোট দিয়ে আর ধোঁকা নয়: খুলনায় হাতপাখার প্রার্থী