১১ বছর বন্ধ থাকার পর রাজশাহীর রাজতিলক নামের সিনেমা হলটি খুলেছে। ‘হাওয়া’ সিনেমার শো দিয়ে চালু হলো হলটি। এই সংবাদ আনন্দের। এই সংবাদ সংস্কৃতির প্রতিভালোবাসার। আমরা উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করেছি, দেশজুড়েই সাধারণ দর্শক হলে যাওয়া কমিয়ে দিয়েছে। হলে দর্শক কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক কার্যকারণ রয়েছে।
এর মধ্যে প্রযুক্তির বিকাশ ও ঘরে ঘরে পৌঁছে যাওয়া একটা বড় কারণ। হাতে একটা স্মার্টফোন থাকলে এবং তাতে আকাশ-সংস্কৃতির সংযোগ থাকলে পুরো বিনোদনজগৎই তো হাতের মুঠোয় এসে যায়। তাহলে আর বাড়তি খরচ করে সিনেমা হলে যাওয়া কেন? একসময় ২৪ ইঞ্চি টেলিভিশন নিয়েই মুগ্ধ থাকত দর্শক। এখন প্রায় সিনেমার স্ক্রিনের সমান টেলিভিশন সেটও পাওয়া যায়। ফলে নিজের ঘরেই সাউন্ড সিস্টেম লাগিয়ে পুরোপুরি সিনেমা হলের আবেশ তৈরি করে ফেলা যায়। একসময় ভিসিআর এসে হলে সিনেমা দেখার স্বভাব বদলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এখনকার প্রযুক্তি ভিসিআরের চেয়ে আরও অনেক দূর এগিয়ে গেছে। ওটিটি প্ল্যাটফর্ম পাল্লা দিচ্ছে সিনেমা হলের সঙ্গে।
সিনেমা হলো অবসর বিনোদনের জায়গা। একসময় সিনেমা হল ছিল মধ্যবিত্তের পারিবারিক সফর। গোটা পরিবার মিলে একদিন আনন্দ-বিনোদনে ভাসার সুযোগ করে দিত সিনেমা হল। বিনোদনের সুযোগহীন নিম্নবিত্তের মানুষও সিনেমার ঝলমলে জগতে নিজেকে নায়ক ভাবতে পারত। সেখানে থাকত গরিবের পক্ষে দাঁড়ানোর আহ্বান। একজন মানুষ সিনেমার নায়ক বা নায়িকার সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে নিতে পারত অনায়াসে। কিন্তু এখন পাড়ার চায়ের দোকানে কিংবা গ্রামের বাজারের যেকোনো দোকানে একটা টেলিভিশন থাকতে দেখা যায়, চাইলেই চ্যানেল বদলে যেকোনো সিনেমা দেখার সুযোগ হয়। কাজের ফাঁকে চা খেতে খেতে সেখানেই যদি সিনেমা দেখা যায়, তাহলে বাড়তি পয়সা নষ্ট করে সিনেমা হলে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হয় না।
আরও একটি ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে গেছে আমাদের সমাজে। ধর্ম নিয়ে যারা ব্যবসা করে, তারা প্রভাবশালী হয়ে ওঠায় দেশের সংস্কৃতিজগতে আঘাত এসেছে। পেট্রোডলারের সঙ্গে সঙ্গে ওহাবীয় মতবাদ এসে গ্রামবাংলার শাশ্বত সংস্কৃতিতে আঘাত হেনেছে। ফলে গ্রামের মানুষের ফুসফুসে বিশুদ্ধ বাতাস এনে দিত যে যাত্রা, পালাগান, আলকাপ, সিনেমা, কবির লড়াই, বাউলগান, তা সুকৌশলে ধীরে ধীরে সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে মানুষের জীবন থেকে। ঋতুর সঙ্গে সম্পর্কিত উৎসবগুলো পালন করতেও নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। আর এর জায়গা নিচ্ছে ওয়াজ মাহফিল। অনেক জায়গায়ই ওয়াজের নামে এমন সব কথা বলা হয়, যা মোটেই ধর্মীয় কথা নয়। এসব ওয়াজে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় নারী সমাজ এবং ভিন্ন ধর্মের মানুষ। এই অরুচিকর অবস্থা কাটিয়ে ওঠা জরুরি।
তবে সবার আগে বলতে হবে, ভালো গল্প, ভালো উপস্থাপন, ভালো অভিনয়সমৃদ্ধ ছবি সিনেমা হলে এলে মানুষ আবার হলমুখী হবে। অন্য কারণগুলোর চেয়ে এ কারণটি অনেক বেশি জরুরি। রাজতিলকের মতো আরও অনেক বন্ধ সিনেমা হল খুলে যাক—এই আমাদের প্রত্যাশা।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে