Alexa
বুধবার, ২২ মার্চ ২০২৩

সেকশন

epaper
 

আস্থা মোদের গুজবে!

আপডেট : ১৪ মার্চ ২০২৩, ১০:৪৯

প্রতীকী ছবি কবি নজরুল আজ থেকে বহু যুগ আগে লিখেছিলেন, ‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখন বসে/বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, হাদিস, কোরান চষে।’ যন্ত্রপ্রযুক্তি ও জ্ঞানবিজ্ঞানের বিকাশধারায় আমরা অনেক এগোলেও চিন্তা ও বিশ্বাসের ক্ষেত্রে আমরা এগোতে পারিনি; বরং অনেক ক্ষেত্রে আমরা পিছিয়েছি। যে যন্ত্রপ্রযুক্তি আমাদের যুক্তির দিশা দেওয়ার কথা ছিল, তা হয়েছে কূপমণ্ডূকতা চর্চার বাহন। এখনো আমরা অনায়াসে বিশ্বাস করি যে বিড়াল কিংবা কুকুরের মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রান্না করে তা বিক্রি হয়। বিরিয়ানিতে মরা মুরগি দেওয়া যেতে পারে, ভেড়া, বকরি, মহিষের মাংসও মেশানো সম্ভব, তাই বিড়াল-কুকুর কেন নয়?

বিড়াল-কুকুর ধরা, জবাই করা এত সহজ নয়। এর নানাবিধ হাঙ্গামা রয়েছে। বিড়াল-কুকুরের মাংস বিক্রি করলে সেটা কঠোর গোপনীয়তা মেনে করতে হবে।একবার ধরা পড়লে পিঠের চামড়া থাকবে না। কাজেই নিয়মিত ঘটনা হিসেবে কেউ বিড়াল-কুকুর জবাই করার ঝুঁকি নেবে না। নেওয়া সম্ভবও নয়। কিন্তু আমাদের দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর একশ্রেণির মানুষ খুব সহজেই বিশ্বাস করেছে যে বিরিয়ানিতে বিড়ালের মাংস মেশানো হয়েছে! এই আজগুবি বিশ্বাসের ক্ষেত্রে কেউ কোনো তথ্য-প্রমাণ-যুক্তি-বুদ্ধিরও ধার ধারেনি!

এর আগে পদ্মা সেতু তৈরির সময় ‘নরবলি’র গুজব ছড়ানো হয়েছিল। সে সময় ‘পদ্মা সেতুর জন্য কোনো বাচ্চার মাথা লাগবে না’—এই মর্মে যোগাযোগ মন্ত্রণালয় বিবৃতি দিতে বাধ্য হয়েছিল। এই গুজবের ভিত্তিতে অপরিচিত কোনো লোক বাড়ির আশপাশে ঘুর ঘুর করতে দেখলে পদ্মা সেতুর সন্নিকটবর্তী এলাকায় উত্তেজিত জনতা ‘ছেলেধরা’ সন্দেহে কয়েকজনকে পিটুনিও দিয়েছে। খোদ রাজধানীতে ছেলেধরা সন্দেহে একাধিক ব্যক্তিকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

আমাদের দেশে করোনা কিংবা ডেঙ্গুর চেয়েও ভয়াবহ রোগের নাম হচ্ছে ‘গুজব’। এখন এর উৎকৃষ্ট জায়গা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। ‘গুজব’ বায়বীয়।শোনা যায়, দেখা যায় না। গুজবকে ভিত্তি দেয় একদল মানুষ। যারা স্বাভাবিক উপায়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারে না, তারাই গুজব রটিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের চেষ্টা করে। কাউকে জব্দ করতে হবে কিংবা কারও কাছ থেকে কাজটা উদ্ধার করতে হবে, কিন্তু পারছে না। দাও ওর বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে। ভালো কোনো কিছু ভন্ডুল করতে হবে, দাও ওই উদ্যোগের নামে গুজব রটিয়ে। এভাবে গুজব রটিয়ে, আগুন ধরিয়ে দিয়ে অনেকেই ‘আলুপোড়া’ খায়। অনেকের এতে সর্বনাশ হয় বটে, কিন্তু স্বার্থান্বেষীরা লাভের আশায় এমন কাজ সুযোগ পেলেই করে! আমাদের সমাজে গুজব এমনই দাওয়াইহীন এক রোগে পরিণত হয়েছে।

‘এইমাত্র আমার পাশের বাসার দুজনের কান চিলে নিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত, আপনার কানও চিলে নিয়ে যাবে। এই মেসেজ এক্ষুনি ভাইরাল করুন।’ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজবগুলোর ধরন অনেকটা এ রকম। এ ধরনের গুজব ছড়ানোর জন্য একশ্রেণির মানুষ যেন সারাক্ষণ তৈরি হয়ে থাকে। আমি পেয়েছি। আপনিও পেয়েছেন। যদি না পেয়ে থাকেন, মুঠোয় ধরা স্মার্টফোনের ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ভাইবার বা হোয়াটসঅ্যাপ খুলে একবার ভালো করে চোখ বোলান। কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই পেয়ে যাবেন তাদের।

মিথ্যা তথ্য দিয়ে, বানানো ছবি-ভিডিও দিয়ে ওরা আপনাকে জানাবে, কোথায়, কোন গলিতে এমন অবাক করা ঘটনা ঘটেছে। কখনো বলবে অনুভূতিতে আঘাত হেনেছে, কখনো জানাবে কাউকে পিটিয়ে মেরেছে। আপনি জানতে পারবেন, হিংস্রতার সবিস্তার বিবরণ। তারা কী অত্যাচারই না করছে! পিটিয়ে মারছে জোয়ান ছেলেটাকে! মাথা কেটে নিচ্ছে। দর দর করে রক্তের নদী বয়ে যাচ্ছে। আপনার চোখের সামনে ভিডিও ক্লিপিংগুলোতে নড়াচড়া করবে এ ধরনের নৃশংসতার দৃশ্য। দুষ্কর্মকারীদের পোশাক-আশাক, দাড়ি-গোঁফ আপনার কাছে ভীষণ চেনা মনে হবে।

এসব দেখে যদি আপনার মাথায় আগুন জ্বলে ওঠে, রাগে-ক্ষোভে আপনার ভেতর থেকে তেজ বিকীর্ণ হতে থাকে, আপনি উত্তেজিত হয়ে ফেসবুকে গোটাকয়েক স্ট্যাটাস দেন—‘এই অপশক্তিকে এখনই ধ্বংস করা উচিত’, তবেই তাদের ‘ধান্দা’ সফল। ওরা বড়শিতে আপনাকে গেঁথে ফেলেছে। এবার আপনি যদি ক্রোধান্ধ হয়ে রাস্তায় নেমে পড়েন, জ্বালাও-পোড়াও করতে পারেন, ভীতি সৃষ্টি করতে পারেন, তবেই ষোলো আনা উশুল। আমাদের মনের গভীর অন্ধকারে ওত পেতে থাকা অপশক্তি সেটাই চায়!

আর যদি আপনি তা না পারেন, তবে ঘরে বসেই ওই সব ফেসবুক, মেসেঞ্জারে এ ধরনের ছবি ও লেখা আরও অনেককে শেয়ার করে নিখরচায় উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢালতে পারেন। হ্যাঁ, এভাবেই চলছে গুজবের আমদানি-রপ্তানি। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত শব্দ এবং ছবির শক্তি বড় ভয়ংকর। পেছনের খেলোয়াড়েরা জেনেবুঝেই এই আগুন নিয়ে খেলছে।

পাশের বিল্ডিংয়ে ছাদ-ঢালাইয়ের কাজ হচ্ছে। সেখান থেকে ইটের একটা টুকরো লেগে একজনের কপাল কেটে গেল, রক্ত চুইয়ে চোখ ভিজে গেল। তাঁর কোনো শুভার্থী হয়তো রুমাল বের করে চোখটা ঢেকে দিয়ে তাকে নিয়ে কোনো একটা হাসপাতাল-ক্লিনিকের উদ্দেশে ছুটলেন। অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা উৎসাহী কেউ এই দৃশ্যের একটা ভিডিও করে ছড়িয়ে দিলেন ফেসবুকে, লিখলেন: এইমাত্র আমার চোখের সামনে একজনের চোখ তুলে ফেলা হলো। এমন দেশ কি আমরা চেয়েছিলাম? আসুন, আমরা নিজের চোখ তুলে ফেলি, না হলে সেই বাচ্চার চোখ তুলে ফেলি! ব্যস, কম্ম কাবার! এরপর আপনার দায়িত্ব কেবল এই জিনিসটা শেয়ার করা, ফরোয়ার্ড করা। এক ঘণ্টায় কয়েক হাজার শেয়ার হয়ে যাবে। এর সঙ্গে আপনি যদি অপছন্দের রাজনৈতিক দলের কর্মী হিসেবে ওই তথাকথিত চোখ উৎপাটনকারীকে চিহ্নিত করতে পারেন, তাহলে প্রতিপক্ষের লোকেরা মনের সুখে শেয়ার দিয়ে যাবে! এটা ভাইরাল হয়ে যাবে।

গুজব জিনিসটা অবশ্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বেশ মুখরোচক। বাঙালি আবার গুজবপ্রিয়। চানাচুরের মতো কুড়মুড়িয়ে গুজব খায়। অন্যের দিকে একমুঠো এগিয়ে দিতেও কার্পণ্য করে না। এখনো মাঝে মাঝে কোথাও না কোথাও আশ্চর্য কেরামতি জানা পাগল-ফকির-দরবেশ বাবার ‘আবির্ভাব’ ঘটে। লোক কাতারে কাতারে ছুটে যায়। পথে মেলা বসে। সেলামির ফান্ড উপচে পড়ে।

আগে আমরা জিন-পরি-দেও-দেবতাদের নিয়ে নানা গুজব শুনতাম। ভূতে ধরা, জিনে আছর করা, পেতনি ছুঁয়ে দেওয়া, দেবতা ভর করা—এসব গুজব আমরা বাল্যকালে প্রচুর শুনেছি। গ্রামবাংলায় প্রচলিত এসবের উৎস গুজব হলেও শেষ পর্যন্ত এগুলো সবই বিশ্বাসে পরিণত হয়। যুক্তি, বুদ্ধি, বিজ্ঞান সব সেখানে তুচ্ছ এবং অপ্রাসঙ্গিক। ভক্তি-স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তখন প্রায় অসম্ভব। তবু বলতেই হবে, এই সব গুজব আপাতভাবে নির্বিষ। এতে সমাজ-সংসার-দেশ-দশের জীবন বিপন্ন হয় না। অন্য কারও বেঁচে থাকার অধিকারে টান পড়ে না। কিন্তু এখন যা হচ্ছে তা ভয়ানক। কখনো ধর্ম অবমাননার নামে, কখনো বিড়ালের মাংসের বিরিয়ানির নামে গুজব ছড়ানো হচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে তা বিষ-ইনজেকশনের মতো আমাদের রক্তে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আপনার বিরুদ্ধে আমি, আমার বিরুদ্ধে অন্য কেউ লাঠি, কাটারি, ছুরি, বন্দুক উঁচিয়ে তেড়ে যাচ্ছি, যেন খ্যাপা ষাঁড়। কৌশল একই। গুজবকে বিশ্বাসে পরিণত করা।

এখন অবশ্য গুজব সৃষ্টি করা হয় রাজনৈতিক মতলব থেকে। কেউ কেউ সত্যিকার ঘটনা ঘটিয়ে সেটাকে গুজব বলে চালায়। আবার আরেক দল আছে যারা ফায়দা হাসিল করার জন্য অপছন্দের ব্যক্তি, দল, গোষ্ঠীকে বেকায়দায় ফেলার জন্য মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে গুজব ছড়ায়। গুজব আসলে যা নয়, তাকে ‘হয়’ বলে চালানোর নোংরা রাজনীতি। ঘটনাচক্রে সোশ্যাল মিডিয়া সেই চক্রান্তের বাহক। আমাদের শুভবুদ্ধি যেখানে তমশাচ্ছন্ন, চারপাশে মতলববাজদের গোপন কুমন্ত্রণা, সেখানে কে কাকে লাগাম পরাবে?

অতএব আসুন, আমরা ভরসা রাখি গুজবে। যুক্তিবুদ্ধি যাচাই করে দেখার মনটাকে কবর দিয়ে বিশ্বাসে-কুসংস্কারের নর্দমায় ভেসে যাই। কখনো গুজবের মাধ্যমে আমরা আগুন-আগুন খেলি। আমি আপনার বিরুদ্ধে, আপনি আমার বিরুদ্ধে, একে অপরের বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে যাই। গুজবে গুজবে সয়লাব হোক জনপদ। এই গুজবের ভিড়ে আসল-নকল হারিয়ে যাক। গুজব ছয়ে, আগুন জ্বেলে ছারখার করে ফেলি দেশ! ভালো কিছু না হোক, দেশের জন্য খারাপটা তো অন্তত আমরা অনায়াসেই করতে পারি!

লেখক: গবেষক ও কলামিস্ট

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    সুষম সার বিষয়ে কতটা সচেতন কৃষক

    ফুকুওকার ফ্লাইট থেকে ফরিদগঞ্জের মাইক

    অযৌক্তিক প্রত্যাশার বলি

    ‘নিশ্চয়ই পার্ট চাইতে এসেছে!’

    বিশুদ্ধ পানি নেই যেখানে

    সাকিব হতে পারতেন রোল মডেল

    স্বর্ণের দাম এক লাফে সাড়ে ৭ হাজার টাকা বাড়ানোর পর কমল ১১০০

    ভাস্কর শামীম শিকদার আর নেই

    ১২ দফা নিয়ে আলোচনার আশ্বাস

    র‍্যাপার ব্যাড বানির বিরুদ্ধে ৪০ মিলিয়ন ডলারের মামলা করল তাঁর প্রাক্তন

    সিঙ্গারের ফ্রি এসি ক্লিনিং সার্ভিস আবারও চালু 

    বাঁশখালীতে হরিণ শিকারের পর জবাই, ৫ জনের কারাদণ্ড