ফেসবুকের কোনো পোস্টে ‘হা হা’ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা যেমন সাধারণ ব্যাপার, তেমনি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু না। কিন্তু এ কথা এখন কে বোঝাবে কাকে? এই স্বাভাবিক ঘটনাগুলোকে কেন্দ্র করে অনেকেই আমরা অঘটন ঘটিয়ে ফেলি। যেমনটা করেছেন দুই শিক্ষার্থী।
একটি ঘটনা রাজশাহীর। ফেসবুকে একজন একটি অনুষ্ঠানের গ্রুপ ছবি পোস্ট করেছেন। সেটায় ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিয়েছেন তাঁর একজন সহপাঠী। কেন তিনি ‘হা হা’ রিঅ্যাক্ট দিলেন, সে কারণে তাঁকে ছুরিকাহত হতে হয়েছে পোস্ট প্রদানকারীর আরেক শুভাকাঙ্ক্ষী সহপাঠীর হাতে! হামলা করার আগে অবশ্য ছুরিকাহত শিক্ষার্থীকে ফোনে শাসিয়ে নিয়েছেন ‘দেখে নেব’ বলে।
আরেকটি ঘটনা ঘটেছে গাজীপুরে। কুয়েটের এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় ফেল করায় আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন রেললাইনের ধারে। ট্রেন আসার অপেক্ষায় ছিলেন। করছিলেন ফেসবুক লাইভ। পুলিশ তাঁকে আটক করে আত্মহত্যার চেষ্টা মামলায় আদালতে পাঠায়। আপাতত আদালত তাঁকে জামিন দিয়েছেন।
যাযাবর তাঁর ‘দৃষ্টিপাত’ বইতে লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কিন্তু কেড়ে নিয়েছে আবেগ।’ কথাটি বহুবার পুনরাবৃত্ত হয়েছে, কিন্তু এখনো পুরোনো হয়ে যায়নি। আবেগই একমাত্র মানুষে মানুষে সম্পর্ক গড়ে দেয়, পরস্পরকে বুঝতে শেখায়। কিন্তু আমাদের এই আবেগ এখন প্রায় শূন্য হয়ে গেছে। ওই দুটি ঘটনাই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
ঘটনা দুটি ভিন্ন কিন্তু সাদৃশ্যের মূল জায়গা হলো অসহিষ্ণুতা, অন্যকে বুঝতে না পারা, পারস্পরিক সংযোগ তৈরি না করা। এই সবকিছু মিলিয়ে আমাদের আবেগ শূন্যের কোঠায় এসে পৌঁছেছে। এ ক্ষেত্রে যে কথা বলতেই হয়—পারিবারিক সম্পর্কে পারস্পরিক যোগসূত্র শক্ত হলে পারিবারিক বন্ধন যেমন অটুট হয়, তেমনি সম্পর্কের সংকটগুলোরও সহজ সমাধান করা যায়। পারিবারিক বন্ধনের যে শক্তি, তা যেকোনো ভাবনার ক্ষেত্রে যুক্তিশীলতা তৈরি করতে সাহায্য করে, অতি আবেগের রাশ টেনে ধরে।
দায়ে পড়ে এখন সবকিছুর অর্থ বোঝার চেষ্টা করছে পশ্চিমা দেশের মনোবিদ ও মানুষ। ভার্চুয়াল জগৎ যে কখনোই বাস্তব জগতের চেয়ে বড় নয়,
সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে তারা। অথচ আমরা চর্চা করছি এর ঠিক উল্টোটা। যেমন—পাশের ঘরে যন্ত্রণাকাতর অসুস্থ মাকে রেখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছি ‘মা
খুব অসুস্থ’ লিখে। অথচ আমাদের মস্তিষ্ক ভাবতেও পারেনি যে কত বড় আহাম্মকির কাজ করছি আমরা! এখানেই প্রশ্ন ওঠে—কোথায় যাচ্ছি আমরা?
ফেসবুকের রিঅ্যাক্টের কারণে যে তরুণ অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন, তিনি নিশ্চয়ই পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্ত। নইলে নিজের অতি আবেগকে তিনি বেঁধে রাখতে পারতেন। আবার যিনি আত্মহত্যার চেষ্টা করলেন, তিনি হয়তো এই যাত্রায় বেঁচে গেছেন, কিন্তু ফেসবুক লাইভ করে অসংখ্য ‘ফেল’ করা মানুষকে শিখিয়ে দিলেন ‘আত্মহত্যা সমাধানের পথ হতে পারে’!
পরিবার, শিক্ষালয় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম—সবখানেই বাস্তব যোগাযোগকে মূল্য দিতে হবে। আমরা যদি পরস্পরকে ঠিকভাবে বুঝে নিয়ে মনোজগৎটা গড়ে নিতে না পারি, তাহলে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতেই থাকবে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে