দেশে যে নানা ক্ষেত্রে, নানা মাত্রায় দুর্নীতি আছে, সেটা সম্ভবত কোনো সুস্থ ও স্বাভাবিক মানুষ অস্বীকার করবেন না। অবশ্য সরকার বা সরকারি দলের পদপদবি যাঁদের আছে, তাঁরা বিষয়টি একেবারেই মানতে চাইবেন না। আরে, দুর্নীতি কোথায়? আমাদের সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়েছে। তাই এখন দেশে দুর্নীতি বলে আর কিছু নেই। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণা দেওয়া আর এর যথাযথ প্রয়োগ এক কথা নয়।
জার্মানিভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বা টিআইয়ের দুর্নীতির ধারণা সূচকেও বাংলাদেশে যে দুর্নীতি আছে এবং সেটা না কমে বরং বাড়ছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেছে। টিআইয়ের এই ধারণা সূচকে বিশ্বের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান এক ধাপ নেমে ১২তম হয়েছে। গত বছর অবস্থান ছিল ১৩তম। এবার ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৫ পয়েন্ট।
টিআইয়ের এই সূচক অনুযায়ী বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া এবং সবচেয়ে কম ডেনমার্ক। এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ আফগানিস্তান। দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে দুর্নীতির মাত্রা সবচেয়ে কম ভুটানে। পাকিস্তান আর কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমকক্ষ হতে না পারলেও দুর্নীতির সূচকে বাংলাদেশের সঙ্গে সমতা রেখে চলছে।
সরকার ও সরকারি দলের পক্ষ থেকে টিআইয়ের এই প্রতিবেদনকে অস্বীকার করা হবে এবং বলা হবে, এটা ঠিক নয়। আমাদের দেশে এই অস্বীকারের সংস্কৃতি এত প্রবল হয়ে উঠেছে যে নিজের পক্ষে না গেলেই সেটা ‘অসত্য’ এবং ‘উদ্দেশ্যপূর্ণ’। এই প্রবণতার কারণেই দুর্নীতিবাজেরা উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্নীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। দেশে আর্থিক এবং অন্যান্য খাতে বড় বড় কেলেঙ্কারি ও জালিয়াতির ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও কাউকে বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত কম। হঠাৎ দু-একজন দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে তৎপরতা দেখা গেলেও তা আইওয়াশের মতোই।
সংসদের চলতি অধিবেশনেও দুর্নীতির প্রসঙ্গটি এসেছে। সরকারের মিত্র হিসেবে পরিচিত ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেছেন, দুর্নীতিবিরোধী অভিযান একটি পর্যায় পর্যন্ত গিয়ে থমকে যায়। কেন এমনটা হয় তা বলেননি তিনি। তবে মনে হয়, কান টানলে মাথা আসে বলে যে কথাটা চালু আছে, সে জন্যই অভিযান থমকে যায়। মাথা টেনে কেউ বুঝি মাথাব্যথা বাড়াতে চায় না!
ঢাকা-১১ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম রহমতুল্লাহও সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে দুর্নীতি বিষয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেছেন।রহমতুল্লাহকে ঢাকার মেয়র হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা গ্রহণ করেননি এই বলে যে ‘ওখানে টেবিল চুরি করে, বাতাসে চুরি করে এবং এখানের মধ্যে সব চোর।’ এসব কারণে মন্ত্রী হওয়ার অফারও তিনি ফিরিয়ে দেওয়ার কথা সংসদে দাঁড়িয়েই বলেছেন।
অর্থনৈতিকভাবে দেশ যেমন এগিয়ে যাচ্ছে, তেমনি দুর্নীতিতেও। নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে পশ্চাদ্গমনের কথা সরকারি মহল অস্বীকার করলেও সত্য এটাই যে দুর্নীতির মহাব্যাধি জাতিকে কুরে কুরে খাচ্ছে। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ঘাটতি দূর না হলে দুর্নীতি চলছে, চলবে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে