একটা জাতির উত্থান-পতনের ইতিহাস পাঠের জন্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের দেশে মাঝেমধ্যে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন অবৈধভাবে দখল করা এবং রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ধ্বংস হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়ে থাকে। কিন্তু আজকের পত্রিকায় যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে তা হলো, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ইজারা দেওয়া নিয়ে। ৩০ জানুয়ারি ‘ইজারায় প্রত্ন আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ’ বিষয়ে যে খবরটি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে রাজধানীর পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক বাহাদুর শাহ পার্ক ইজারা দেওয়ার মতো ভয়ংকর ব্যাপার রয়েছে। এ নিয়ে বেশ কিছু দিন ধরে স্থানীয় মানুষ এবং সচেতন নাগরিক সমাজের উদ্যোগে আন্দোলনও হচ্ছে।
বাহাদুর শাহ পার্ক বহু ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। একসময় এটি আন্টাঘরের ময়দান নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৮ সালে রানি ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এখানেই এ-সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। সেই থেকে এই স্থানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’। ১৯৫৭ সালের আগপর্যন্ত পার্কটি ভিক্টোরিয়া পার্ক নামে পরিচিত ছিল। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের বছরটিকে ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রাম বলা হয়। ১৮৫৭ সালের পর এই জায়গায় এক প্রহসনমূলক বিচারে ইংরেজ শাসকেরা ফাঁসি দেয় অসংখ্য সিপাহিকে। আবার জনগণকে ভয় দেখাতে সিপাহিদের লাশ এনে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় এখানকার বিভিন্ন গাছের ডালে। ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১) সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে এখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে পার্কের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বাহাদুর শাহ পার্ক। কারণ, সিপাহি বিদ্রোহ অনুষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ শাসনের সমাপ্তি ঘটিয়ে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহের শাসন পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তাই তাঁর নামানুসারে এর নতুন নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।
মূলত দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখভালের দায়িত্ব প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের। কিন্তু খবরের সূত্রে জানা যায়, পার্কের ইজারা দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ। যদিও মেয়র এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা মেয়রের বরাতে জানিয়েছেন, ‘আমার মনে হয় এটা হিউমিলিয়েটিং প্রশ্ন। কারণ, লিজ দেওয়া হয় উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে।’ আবার বাহাদুর শাহ পার্ক প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর না ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অধীনে, সেটিও স্পষ্ট নয়।
আমাদের কথা হলো পার্কটি কোন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে রক্ষণাবেক্ষণ হবে, সেসবের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কথা হলো ঐতিহাসিক এ পার্কটি কেন ইজারা দিতে হবে? কারণ, ঢাকা শহরে খাবার হোটেল-রেস্তোরাঁ করার মতো জায়গার অভাব নেই। একমাত্র লোভী এবং ইতিহাসবিস্মৃত মানুষেরাই এ রকম অবিবেচনাপ্রসূত কাজ করতে পারে। দেশে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে রাষ্ট্রীয় আইন আছে। কিন্তু এসব আইন কেউ কেউ আমলে নিতে চায় না। এ কারণে এই রকম ঐতিহাসিক জায়গা সহজেই ইজারা দেওয়া হয়ে থাকে।
ইজারা বাতিল করে পার্কটিকে স্বমহিমায় সুরক্ষিত রাখার যাবতীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে যথাযথ কর্তৃপক্ষ, আমরা সেটাই চাই।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে