‘সাঁতাও’ এমন এক জনপদের চিত্র, যেখানে জীবন চলছে সরলরেখায়। সীমিত চাহিদা, প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম আর পারিবারিক বন্ধনকে সঙ্গী করে যারা জীবন সাজানোর স্বপ্ন দেখছে, সাঁতাও তাদেরকেই তুলে এনেছে ফ্রেমে। সাধারণত সিনেমায় একটা গল্প থাকে। কিছু কিছু সিনেমায় সেটা থাকে না, কিন্তু সেখানেও দৃশ্যের বুনটে ধরা পড়ে আকর্ষণীয় কোনো মুহূর্ত বা নির্মাতার চিন্তা-দর্শন। ‘সাঁতাও’ এসবের ধার ধারে না। কোনো নির্দিষ্ট গল্প বলা হয় না, নির্দিষ্ট কোনো সমাপ্তিতে পৌঁছানোর তাড়া নেই। সংলাপও খুব কম, যা আছে তাও সাধারণ জীবনের অনুজ্জ্বল কথাবার্তা, বাড়তি কোনো চমক দেখানোর চেষ্টা নেই। স্রেফ বিশ্বাসযোগ্যতার কাঁধে ভর দিয়ে বোনা হয়েছে প্রতিটি দৃশ্য।
‘সাঁতাও’-এর প্রেক্ষাপট দেশের উত্তরাঞ্চলের একটা গ্রাম। সেখানে পায়ে পায়ে মিশে আছে অভাব-অনটন। সেই অভাবের মলিনতাকে মানুষ জয় করেছে উৎসবের উজ্জ্বলতা দিয়ে। নৌকাবাইচ, মাছ ধরার উৎসব কিংবা বিয়ের অনুষ্ঠানের সঙ্গে এত নিবিড়ভাবে মিশে গেছে জনজীবন, প্রতিটি উৎসব নিয়েই মানুষ গান বেঁধেছে। সে গান মানুষের মুখে মুখে ফেরে। সেই গ্রামের এক দম্পতি ফজলু ও পুতুল। ফজলু ফসল ফলায়, মাছ ধরে, গ্রামে টুকটাক যা কাজ পায়, করে। আর পরম মমতা দিয়ে সংসার আগলে রাখে পুতুল। এরা দুজন বাদে সংসারে আছে আরও এক সদস্য—একটি গরু। পুতুল যখন গর্ভবতী হয়, একই সঙ্গে আসে গরুর গর্ভবতী হওয়ার সুসংবাদও।
বাচ্চা জন্ম দিতে গিয়ে গরুটা মারা গেলে বাছুরটি হয়ে ওঠে ফজলু ও পুতুলের সন্তান। তাকে কোনোভাবেই চোখের আড়াল হতে দেয় না পুতুল। বাছুরটির প্রতি পুতুলের মাতৃস্নেহ আরও প্রবল হয়ে ওঠে, যখন সে মৃত সন্তান প্রসব করে এবং একপর্যায়ে জানতে পারে, মা হওয়ার সক্ষমতা আর তার নেই। এরপর ঋতু বদলায়, শুষ্ক খরার দিন শেষে আসে বর্ষাকাল। বাঁধ খুলে দিলে প্লাবিত হয় ঘর-বসতি, ফসলের খেত। পানি নেমে গেলে আবার মানুষ নয়া দিনের স্বপ্নে ঘর সাজায়।ঋতুবদলের এসব চিত্র এতটা বাস্তবের আবরণে তুলে এনেছেন নির্মাতা, মাঝেমধ্যে ভ্রম হয়—কোনো তথ্যচিত্র দেখছি না তো!
ফজলু ও পুতুল—দুই চরিত্রের হাত ধরে ‘সাঁতাও’-এর গল্প জাম্পকাটে খুব দ্রুত এগিয়ে চলে। কোথাও স্থির হয় না। এটাই সাঁতাওয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য। নির্দিষ্ট কোনো গল্প বলার চেয়ে জীবনযাপনের সূক্ষ্ম চিত্র দেখানোর দিকেই বেশি মন দিয়েছেন নির্মাতা। আর তাঁর যোগ্য সঙ্গী হয়ে প্রতিটি দৃশ্যে নিজেদের সর্বোচ্চ পরিশ্রম ঢেলে দিয়েছেন প্রধান চরিত্রের দুই অভিনয়শিল্পী ফজলুল হক ও আইনুন পুতুল। তাঁদের মেদহীন, বিশ্বাসযোগ্য অভিনয়ের ওপরেই দাঁড়িয়ে আছে সিনেমাটির জার্নি।
‘সাঁতাও’ তৈরি হয়েছে গণ-অর্থায়নে। অর্থাৎ এর প্রযোজক এক-দুজন নয়, হাজার হাজার মানুষের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আর্থিক অবদানে সিনেমাটি তৈরি করেছেন খন্দকার সুমন। দেশের সিনেমার ইতিহাসে এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ একটি ঘটনা হয়ে থাকবে। তবে বাস্তবের দৃশ্য নির্মাণ করতে করতে গল্পের শেষ দিকে এসে, ঋণের দায়ে বাছুর হাতছাড়া হওয়াকে কেন্দ্র করে নির্মাতা আশ্রয় নিয়েছেন মেলোড্রামার। ফলে গল্প তার স্বাভাবিক প্রবণতা হারিয়ে যেন দিগ্ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। এটুকু অস্বস্তি এড়িয়ে গেলে ‘সাঁতাও’-এর আগাগোড়া দারুণ উপভোগ্য।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে