রাজধানীর ফকিরাপুল ট্রাফিক পুলিশ বক্স থেকে ইনার সার্কুলার রোড ধরে টিঅ্যান্ডটি উচ্চবিদ্যালয় মোড়ের দিকে যেতে ডান পাশে সারি সারি হোটেল। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে হকারদের ব্যস্ততার মধ্যেই কানে আসে– ‘স্যার, ভালো রুম আছে; আসেন, দেইখা যান।’ টিঅ্যান্ডটি উচ্চবিদ্যালয় পর্যন্ত যেতে এমন অসংখ্য ডাক শোনা যায়। এমন ডাকাডাকি যাঁরা করেন, তাঁদের কয়েকজন জানান, তাঁরা পাশের বিভিন্ন হোটেলের কর্মচারী। ৪০০ মিটার পথের পাশে ৩৩টি আবাসিক হোটেল। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, হোটেলগুলোতে যাঁরা ওঠেন তাঁদের বেশির ভাগই বিদেশগামী এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের।
গত মঙ্গল থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ফকিরাপুলের এসব হোটেল ও ফুটপাত ঘুরে বিদেশগামী লোকজনের ব্যস্ততা দেখা গেছে। কারও কারও সঙ্গে আছেন স্বজনেরাও। কেউ বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিচ্ছেন, কেউ বারান্দায় বা লবিতে দাঁড়িয়ে ফোনে কথা বলছেন। ব্যস্ততায় কথা বলার ফুরসত পান না হোটেল ম্যানেজাররাও। কেউ কেউ শেষ মুহূর্তে ফুটপাত থেকে কম দামে নানা জিনিস কিনে নিচ্ছেন। অনেকে বিদেশে যাওয়ার আগে হোটলে এক থেকে সাত রাত পর্যন্ত থাকেন। প্রতারণার শিকার হলে কাউকে কাউকে থাকতে হয় আরও বেশি দিন। অনেক প্রতারক ও মানব পাচারকারীও ওত পেতে থাকে এই এলাকায়ই।
বছর দুয়েক আগে গোয়েন্দা সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, সারা দেশে মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। এর মধ্যে রাজধানীর ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, বনানীসহ বিভিন্ন স্থানে থাকা ডজনখানেক ট্রাভেল এজেন্সি মানব পাচারে জড়িত। পুরানা পল্টনে নুরজাহান শরীফ প্লাজার পঞ্চম তলায় রিক্রুটিং এজেন্সি এমআরটি ইন্টারন্যাশনালের (আরএল নম্বর ৩১৯) কার্যালয়। এজেন্সিটি ভিয়েতনামে মানব পাচারে জড়িত বলে ২০২০ সালে প্রমাণ পায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
পাচারে ট্রাভেল এজেন্সির সম্পৃক্ততা প্রসঙ্গে সিআইডির গুরুতর অপরাধ বিভাগের প্রধান ও বিশেষ সুপার নজরুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পাচারকারীরা প্রথমে গ্রাম থেকে বেকারদের টার্গেট করেন। এরপর তাঁদের ঢাকার দালালের হাতে দেন। দালালরা ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে ভিসা ও টিকিট করে তাঁদের মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে নিয়ে যান। সেখান থেকে অন্য দেশেও পাচার করে। গত নভেম্বরে আমরা ইরান থেকে এমন একজন ভুক্তভোগীকে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছি। তাঁকে ট্রাভেল এজেন্সি ভ্রমণ ভিসায় দুবাই পাঠিয়ে ইরানে পাচার করেছিল।’
বারবার ফকিরাপুলের নাম
পাচারের উদ্দেশ্যে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা এক কিশোরীকে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ফকিরাপুল এলাকা থেকে উদ্ধার করে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ওই ঘটনায় এক নারীসহ পাচারকারী চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। তখন র্যাব জানিয়েছিল, ফটিকছড়ির দরিদ্র পরিবারের মেয়েটি হাটহাজারীতে একটি বাসায় কাজ করত। সে নিখোঁজ হওয়ায় তার বাবা হাটহাজারী থানায় জিডি করেন। পরে তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে র্যাব কিশোরীর অবস্থান শনাক্ত করে ঢাকার ফকিরাপুলের একটি বাস কাউন্টারের সামনে থেকে উদ্ধার করে।
মানব পাচারকারী চক্রের পাঁচ সদস্যকে ২০১৯ সালের ২ ডিসেম্বর ফকিরাপুল থেকে গ্রেপ্তার করে সিআইডি। তাঁদের কাছ থেকে ৮৬টি জাল পুলিশ ক্লিয়ারেন্স সনদসহ বিভিন্ন জাল কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছিল। তখন সিআইডি জানিয়েছিল, গ্রামের সহজ-সরল তরুণীদের বিদেশে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে সর্বস্বান্ত করাই চক্রটির প্রধান কাজ। নানা সনদ জালিয়াতির মাধ্যমে বিদেশে মানব পাচার করত চক্রটি। পাচারকারী চক্রের দুই সদস্য পান্না ও তৈয়ব ফকিরাপুলের এমএইচ ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে সৌদি আরবে লোক পাঠাত। একই বছরের অক্টোবরে ফকিরাপুল এলাকা থেকে মানব পাচারকারী চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছিল র্যাব। গ্রেপ্তার করা চারজনের মধ্যে নড়াইলের লোহাগড়ার বাকা (লক্ষ্মীপাশা) গ্রামের রেজাউল করিম বিশ্বাস থাকতেন ফকিরাপুল এলাকায়।
জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিজের (বায়রা) মহাসচিব মো. শামীম আহমেদ চৌধুরী নোমান অবশ্য বলেন, ‘আমরা এর আগে কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছিলাম। কিন্তু তদন্ত করে দেখা গেছে, বেশি অভিযোগ ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর বিরুদ্ধে। যারা টিকিটিংসহ ভ্রমণ ভিসা করে থাকে, তারা অনিয়মগুলো করে। আমাদের কিছু রিক্রুটিং এজেন্সির বিরুদ্ধেও অভিযোগ আসে। তবে সেগুলোর বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা হবে।’
এজেন্সি থেকেই মেলে হোটেলের ঠিকানা
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আল আকসা হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, ম্যানেজার আকবর হোসেন পাভেল কোন রুমে কতজন আছেন, তার হিসাব মেলাচ্ছিলেন। তিনি বলেন, ‘তাঁদের হোটেলে বেশির ভাগ লোকই আসেন রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে। এজেন্সিগুলোর সঙ্গে তাঁদের আগে থেকেই কথা বলা থাকে। বিদেশগামীদের তারা হোটেলের ঠিকানা দিয়ে পাঠায়।’ পাভেল বলেন, ফকিরাপুলের হোটেলগুলো রিক্রটিং এজেন্সির মাধ্যমেই বেশি অতিথি পায়। অনেক বিদেশগামী সপরিবারেও আসেন।
দেশের অধিকাংশ রিক্রুটিং ও ট্রাভেল এজেন্সির অফিস ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, পুরানা পল্টন, কাকরাইল ও মতিঝিল এলাকায়। বিদেশগামীরা আগে এসব অফিসে যান। রাতে থাকতে হলে কাছের কোনো হোটেলে গিয়ে ওঠেন। তাই ফকিরাপুলের হোটেলের চাহিদা বেশি। নয়াপল্টনে রিক্রুটিং এজেন্সি রাকিব ইন্টারন্যাশনালের মালিক শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘গ্রাম থেকে অনেকেই ঢাকায় নতুন আসেন। জীবনে কোথাও যাননি—এমন তরুণেরাও বিদেশে যান। তাঁরা স্বজন নিয়ে আসেন। তাঁরাও ঢাকার কিছু চেনেন না। রাতে থাকার প্রয়োজন হলে তাই আমাদের স্টাফরা তাঁদের কাছাকাছি হোটেলের ঠিকানা দিয়ে দেন। ফকিরাপুলের হোটেল কাছাকাছি হওয়ায় সেখানেই পাঠাই।’
অনেক দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী
ফকিরাপুলে হোটেল আজমেরির (আবাসিক) সামনে দেখা যায়, মাদারীপুর থেকে ভাগনি শামীমাকে নিয়ে এসেছেন সাহাবুদ্দিন। শামীমার ভাই-বোন, মাও আছেন। পছন্দের হোটেল খুঁজছেন। কথা বলে যানা যায়, স্বামী পরিত্যক্তা শামীমা সৌদি আরব যাবেন গৃহপরিচারিকার কাজ নিয়ে। শামীমা বলেন, ‘আমার এক মেয়ে আছে। তার জীবনটা যাতে আমার মতো না হয় সে জন্য বিদেশ যাচ্ছি। জানি অনেক কষ্ট হবে, তারপরও থাকব।’
পরে হোটেলের ম্যানেজার পারভেজ বলেন, ‘নিম্নবিত্ত যাঁরা প্রথমবার বিদেশে যান, তাঁরা এই এলাকার হোটেলে বেশি ওঠেন। টাকাপয়সা একটু বেশি হলে এদিকে আর আসেন না।’
আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের রেমিট্যান্স (প্রবাসী আয়) যোদ্ধাদের অনেক দীর্ঘশ্বাসের নীরব সাক্ষী এসব হোটেল।
প্রিন্স গার্ডেন হোটেলে গিয়ে দেখা যায়, নোয়াখালীর তরুণ সাগর এসেছেন কৃষক বাবার সঙ্গে। বাবা ইসমাইল হোসেন জানান, ছেলেকে ঋণ করে মালয়েশিয়া পাঠাচ্ছেন। কারণ, দেশে কাজ মিলছে না। সারা দিন রিক্রুটিং এজেন্সির অফিসে ছিলেন। রাতেই বিমানবন্দরে যেতে হবে। একটু বিশ্রাম নিতে হোটেলে আসা।
হোটেলের ম্যানেজার মুকুল বলেন, ‘সাত-আট বছর ধরে এখানে আছি। কত মানুষ দেখলাম। কত কষ্ট করে মানুষ বিদেশে যায়, তার সাক্ষী আমরা।’ তিনি আরও বলেন, ‘প্রবাসীরা কত কষ্ট করে, তা আমরা উপলব্ধি করি। তাঁরা রেমিট্যান্স নিয়ে আসেন, কিন্তু সবখানে তাঁদের হয়রান হতে হয়। তাঁরা রাষ্ট্রের কাছে টাকার মেশিন। তাঁদের আর কোনো মূল্যায়ন নেই।’
হোটেলগুলোর মধ্যে আরও আছে সাকিল ইন্টারন্যাশনাল (আবাসিক), হোটেল পারাবত, হোটেল আসর (আবাসিক), হোটেল বায়তুল ক্বারার (আবাসিক), নিউ মিতালী আবাসিক হোটেল, হোটেল মুনস্টার, হোটেল আইডিয়াল, হোটেল ইস্টার্ন, দোস্তী হোটেল, হোটেল জোনাকি, হোটেল ব্লু ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল সিটি ভিউ, হোটেল ফ্যালকল, হোটেল আরামবাগ, হোটেল গ্রান্ড ফয়সাল, হোটেল আসমা, হোটেল আল আমিন, হোটেল নিশিবাস, হোটেল তাজমহল, হোটেল শেলটার ইত্যাদি।
ফুটপাতে জুতা বিক্রি করেন তৌফিক। তিনি বলেন, ‘যাঁরা বিদেশ যান, তাঁরা এবং পরিবারের সদস্যরা কিনে নিয়ে যান। ব্যবসা ভালো হয়। সব আদম আসেন, এটা আদমের হাট।’
সবাইকে সচেতন হওয়ার পরামর্শ
ব্র্যাকের মাইগ্রেশন বিভাগের প্রধান শরিফুল হাসান আজকের পত্রিকাকে বলেন, কোভিড মহামারির পর ২ লাখ লোক ভ্রমণ ভিসায় দুবাই গেছেন। তাঁদের একটি অংশ ইরান-তুরস্ক হয়ে ইউরোপে যেতে চায়, আরেকটি অংশ লিবিয়া হয়ে সমুদ্রপথে যেতে চায়। মানুষ সচেতন না হলে এই পাচার ঠেকানো যাবে না। সবাইকে সচেতন হতে হবে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর উচিত পাচারকারীদের একটি ডেটাবেইস করা, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে