সন্তানের পাশে মা কখনো লড়েন নিজের সঙ্গে, কখনো লড়েন সমাজ, পরিবার কিংবা পারিপার্শ্বিকতার সঙ্গে। লড়াইটা চলতে থাকে যেকোনো একজনের প্রস্থানের আগ পর্যন্ত। সারাহ ইসলাম ঐশ্বর্য তাঁর জীবনযাপনের লড়াই শেষ করলেন মাত্র ২০ বছর বয়সে। সেই সঙ্গে শেষ হলো তাঁর মা শবনম ইসলামের লড়াইও! মা ও মেয়ের লড়াইটা শেষ হলো এক গৌরবগাথার মধ্য দিয়ে।
জন্মের ১০ মাস পর থেকেই খিঁচুনি আর জ্বরে প্রায়ই আক্রান্ত হতো ছোট্ট সারাহ। তাই বারবার ইমার্জেন্সিতে ভর্তি করানো হতো তাঁকে। মেয়ের প্রথম অসুস্থতার সেই দিনটি আজও স্পষ্ট মনে আছে শবনম ইসলামের। স্মৃতি হাতড়ে তিনি বললেন, ‘একদিন সকালে উঠেই দেখি সারার অনেক জ্বর, চোখ খুলছে না। নিয়ে গেলাম ইমার্জেন্সিতে। চিকিৎসক ডেকে ধারণা দিলেন রোগ সম্পর্কে। রোগটা বিরল, অনেকেই জানেন না। আমরাও জানতাম না। তখন ইন্টারনেটের এত ব্যবহারও ছিল না। চিকিৎসক ধীরে ধীরে আমাদের সব জানান। কাজের কারণে মেয়েকে খুব একটা সময় দিতে পারতাম না। কিন্তু হাসপাতালে একটা সেকেন্ডও আমি ওকে ছাড়তাম না। আমার পরিবারের সবাই আমাকে অনেক সাহায্য করেছে।’
গত ২০ বছরে মা ও মেয়েকে হাঁটতে হয়েছে অনেক বন্ধুর পথ। শবনমের কথায় উঠে এসেছে সারাহর স্কুলজীবনের কষ্টের দিনগুলো, যেখানে স্বাভাবিক শিশু হিসেবে ওকে অনেকেই মেনে নিতে পারত না। অনেকেই পাশে বসতে চাইত না। ছোট্ট সারাহ কষ্ট পেত, মাকে এসে বলত তার অভিমানের কথা। সারাহ লড়েছেন শারীরিক ও মানসিকভাবে। দৈহিক ব্যথার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষের অবজ্ঞা ও অবহেলাও ছোটবেলা থেকে সহ্য করতে হয়েছে তাকে। তবে অনেক শিক্ষক ছিলেন, যাঁরা সারাহর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধু হয়ে।
এসব ঘটনাই কি সারাহকে অন্যরকমভাবে ভাবতে শিখিয়েছিল? জগতের মায়া ত্যাগ করেও ব্রেন ডেড সারাহ দান করে গেছেন তাঁর কর্নিয়া ও কিডনি। এর মাধ্যমে সহজ হয়েছে আরও চারজন মানুষের জীবন। সারাহর মতো সাহসী একজন সন্তানের মা হতে শবনম ইসলামকেও হয়তো অনেক দুঃসাহসী হতে হয়েছিল!
ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভ বা ইউডায় চারুকলা বিভাগে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন সারাহ। হাসপাতালে বসে মাকে ফোন করে পরীক্ষা দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। শবনম ইসলাম মেয়ের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কথায় কথায় তিনি জানিয়েছিলেন, সারাহ কোনো দিন অন্যায় আবদার করেনি। সে স্পষ্টবাদী আর সত্যবাদী মেয়ে ছিল। সজ্ঞানে কখনো কারও খারাপ চিন্তা করেনি।
যেদিন সারাহ প্রথম তাঁর অঙ্গদানের কথা বলেছিলেন, সেদিন হয়তো তিনি নিজেও জানতেন না এত দ্রুত চলে যাবেন। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অসুস্থতা, অপারেশন আর মৃত্যুর কথা ভেবেই হয়তো এই ইচ্ছা হয়েছিল তাঁর। শবনম ইসলাম জানিয়েছেন, দুই-তিন মাস আগে যখন হাসপাতালে ভর্তি হন, তখন একদিন অঙ্গদানের কথা বলেছিলেন তিনি।
শবনম জানিয়েছেন, ‘হাসপাতালে যাওয়ার পর থেকেই কিছু কিছু ইচ্ছার কথা প্রায়ই আমাকে বলত। বিশেষ করে ব্রেন দেওয়ার কথা বলেছিল সে। লিখিত দিয়ে যেতে পারেনি। কিন্তু মায়ের ওপরে ভরসা রেখেই ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছিল সে।’
সারাহকে পাওয়ার আনন্দ, তাঁর প্রথম হাঁটা, প্রথম হাত বাড়ানো, প্রথম মা বলা, প্রথম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়—এগুলো কখনোই স্মৃতি থেকে মুছে যাবে না শবনম ইসলামের। যখন একা থাকেন, তখন এই স্মৃতিগুলোই বারবার ঘুরেফিরে আসে তাঁর কাছে। এভাবেই সারাহ বেঁচে থাকবেন তাঁর মায়ের সঙ্গে।
সারাহ এখন জাতীয় সম্পদের মতোই হয়ে গেছেন বলে মনে করছেন তাঁর মা শবনম। কিছুটা গর্বিত কণ্ঠেই বললেন, ‘সারাহ এখন এই দেশের সন্তান।’
গত ৭ নভেম্বর ছিল সারাহর জন্মদিন। গত বছরের জন্মদিনটাই যে সারাহর সঙ্গে কাটানো শেষ জন্মদিন হবে, এটা ভাবেননি কেউই। সেই জন্মদিনে শবনমের দেওয়া টপসটিই যে সারাহর জীবনে মায়ের কাছে পাওয়া শেষ জন্মদিনের উপহার হবে, এটাও ভাবেনি কেউ। বছর ঘুরে আবারও আসবে ৭ নভেম্বর, সারাহর পৃথিবীতে আগমনের দিন। তেমনি আসবে ১৮ জানুয়ারি, যেদিন সারাহ চলে গেছেন এই পৃথিবী ছেড়ে। যাওয়ার আগে অন্য চারজনকে দিয়ে গেছেন নিজের দুটি কিডনি ও কর্নিয়া। আর তাই সারাহ ইসলামের চলে যাওয়াটা কোনো স্বাভাবিক চলে যাওয়া নয়।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে