ঢাকার বাসিন্দা শিক্ষক শবনম সুলতানা ও শহিদুল ইসলাম দম্পতির জ্যেষ্ঠ সন্তান সারা ইসলাম মাত্র ২০ বছর বয়সেই মৃত্যুবরণ করেন। নিজে মরে তিনি চারজনকে দিয়েছেন নতুন জীবন। মরণোত্তর অঙ্গ দানের ঘটনা নতুন না হলেও সারা ইসলামের ঘটনাটি নানা কারণে ব্যতিক্রমী এবং আমাদের চিকিৎসাশাস্ত্রের জগতে ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
শুক্রবারের আজকের পত্রিকায় প্রকাশিত খবরটি পড়ে অনেক পাঠকেরই মনে পড়বে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দুটি লাইন: ‘অন্ধজনে দেহো আলো, মৃতজনে দেহো প্রাণ—/তুমি করুণামৃতসিন্ধু করো করুণাকণা দান।’
বুধবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন সারাকে ‘ব্রেন ডেথ’ ঘোষণা করা হয়। সারা মরণোত্তর অঙ্গ দান করে যাওয়ায় তাঁর কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দুজনের দেহে আর কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করা হয়েছে দুজনের চোখে। আমাদের দেশে মরণোত্তর কর্নিয়া দানের ঘটনা আরও থাকলেও মরণোত্তর কিডনি দান ও প্রতিস্থাপন এটিই প্রথম। কিডনি দুটি পেয়েছেন দুই নারী এবং কর্নিয়া পেয়েছেন একজন নারী এবং একজন পুরুষ। তাঁরা চারজনই সুস্থ আছেন।
সারা অগ্রণী স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে এসএসসি আর হলিক্রস কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ভর্তি হয়েছিলেন ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভের চারুকলা বিভাগে। টিউবেরাস স্ক্লেরোসিস নামক খুব জটিল ও ‘রেয়ার’ একটি রোগে আক্রান্ত ছিলেন তিনি। এই রোগ ভালো করার কোনো উপায় এখনো আবিষ্কৃত হয়নি। ফলে যন্ত্রণাদায়ক এই রোগের সঙ্গে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হতো তাঁকে। তারপরও নিজের ভালো লাগার কাজগুলো করতে করতে ঠিকই এগিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ১০ জানুয়ারি তাঁর মস্তিষ্কের টিউমার অপসারণের জন্য একটি অপারেশন করা হয়। অবস্থার অবনতি হলে পরে নেওয়া হয় লাইফ সাপোর্টে। কিন্তু চিকিৎসকেরা বুঝতে পারেন সারাকে আর বাঁচিয়ে রাখা যাবে না। তাঁর শেষ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কিডনি ও কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের উদ্যোগ নিয়ে সফলতা পাওয়া যায়।
কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা অনুযায়ী এ কাজটি খুব সহজ ছিল না। মৃত ব্যক্তির অঙ্গ প্রতিস্থাপনের বিষয়টি পরিবারের সদস্যরা খুব সহজে মেনে নিতে চান না। সারার পরিবার বিষয়টি উদারভাবে গ্রহণ করাতেই এ ক্ষেত্রে একটি উজ্জ্বল ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল।
জানা যায়, দুরারোগ্য ব্যাধি নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকা সারা তাঁর পরিচিতজনদের উপহার দিতে খুব পছন্দ করতেন। আর তাই সম্ভবত মৃত্যুর আগমুহূর্তেও উপহার দিতে ভোলেননি। সারা চলে গেলেও তাঁর দেওয়া কিডনি নিয়ে নতুনভাবে বাঁচার সুযোগ পাচ্ছেন দুজন মানুষ। আর তাঁর দান করা কর্নিয়া প্রতিস্থাপনের পর আরও দুজন পৃথিবীটাকে দেখতে পারবেন নতুন করে। তাঁর এই ত্যাগের মাধ্যমে আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে মরণোত্তর অঙ্গ দানের বিষয়ে আরও অধিক সচেতনতা তৈরি হবে বলে আমরা মনে করি।
পৃথিবীর জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য সারা সুন্দর ও সেরা উপহারই দিয়ে গেলেন। এভাবেই সারা মৃত্যুঞ্জয়ী হলেন।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে