শনিবার, ১০ জুন ২০২৩

সেকশন

 

শিক্ষক, শিক্ষাবিদ এবং মানহীন শিক্ষাচক্র

আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০২২, ১০:০০

প্রতীকী ছবি মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা আমরা নিশ্চয়ই চাই। তবে সেই চাওয়াটা অগ্রাধিকারের দিক থেকে কোন পর্যায়ে, তা বোঝার জন্য আমার আজকের জিজ্ঞাসার অবতারণা।

প্রাথমিক শিক্ষার পরিমাণগত অর্জন আমাদের আশান্বিত করেছে। বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ও প্রয়োজনীয়সংখ্যক প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করাসহ প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের নানা কর্মসূচির সুফল আমরা পেয়েছি পরিমাণগত লক্ষ্য অর্জনে। কিন্তু মানের প্রশ্নে আজও সদুত্তর মেলে না। এর কারণ কী? শিক্ষার মানোন্নয়ন মূলত শিক্ষকের ওপরই বর্তায়। কেননা, তিনিই তো শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কারিগর। সেই শিক্ষকের মানোন্নয়ন না করে মানসম্মত শিক্ষা দুরাশা মাত্র।

স্বাধীন বাংলাদেশ ৫০ বছর পেরোল, তবু তার এইটুকু দূরদৃষ্টি অর্জিত না হওয়া আমাকে হতাশ করে। জনবহুল বাংলাদেশ কৃষিতে সম্পূর্ণতা অর্জনের পথে। কেননা, তার বিপুল জনগোষ্ঠীর খাদ্যাভাব তাকে ভাবিয়েছে ঢের। অথচ খাদ্যের জোগানের পাশাপাশি এই জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে পরিণত করার যে তাড়না, তা তাঁকে তাড়িত করতে পারেনি।

হয়তো সে জন্যই কৃষিতে আমরা যা পেয়েছি, শিক্ষায় তা অধরা রয়ে গেছে। কৃষিতে সাফল্যের পেছনের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, কৃষক, কৃষিবিদ ও কৃষিবিজ্ঞানীর মেলবন্ধনে অনুকূল কর্মপরিবেশ সৃষ্টি, কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে সরকারের বিনিয়োগ, কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ প্রসারিত করার মাধ্যমে দক্ষ কৃষিবিদ তৈরি এবং দক্ষ কৃষিবিদের হাতেই কৃষির সব ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার ক্ষেত্রে তা হয়নি।

শেষ করে প্রাথমিক শিক্ষা, যা শিক্ষার ভিত্তিভূমি রচনা করে। প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে দুই দশকের বেশি সময় ধরে চলমান ‘প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি’র নানা উদ্যোগ, যেমন ব্যাপকভাবে শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, বিদেশে উচ্চশিক্ষা ও প্রশিক্ষণ গ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি, সি-ইন-এড প্রশিক্ষণের মানোন্নয়ন ঘটিয়ে ডিপিএড প্রবর্তন ও এর সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটকে যুক্ত করা, শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি প্রদান, কারিকুলাম ও পাঠ্যসূচির পরিমার্জন, সময়মতো সব শিশুর হাতে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেওয়া, বিদ্যালয়ের ভৌত সুবিধার সম্প্রসারণসহ অনেক ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। পাশাপাশি সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও নেওয়া হয়েছে উদ্যোগ, যা জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের চেষ্টা সরকারের সদিচ্ছার প্রকাশ।

১৯৭৩ সালে জাতির পিতার এক ঘোষণায় ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করা হয়, সেই পথ অনুসরণ করে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ২০১৩ সালে একযোগে ২৬ হাজার ১৯৬টি রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি সরকারের অগ্রাধিকারকে তুলে ধরে। কিন্তু প্রাথমিক শিক্ষার মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ খাতকে পরিচালনার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরির কোনো কার্যকর উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি।

দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে অনেক দিন হলো। ফলে শিক্ষা গবেষণারও সুযোগ প্রসারিত হয়েছে। যদিও শিক্ষা দপ্তরের সঙ্গে এর যোগসূত্র খুবই ক্ষীণ। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে যাঁরা শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মে নিয়োজিত হচ্ছেন, তাঁদের নিজেকে শিক্ষাবিদ হিসেবে গড়ে নেওয়ার সদিচ্ছা রয়েছে নিঃসন্দেহে। তাঁদের অনেকেই যোগ্যতার প্রমাণ রাখছেন নানা আন্তর্জাতিক সংস্থায়। সরকারি শিক্ষা দপ্তরেও শতাধিক প্রাতিষ্ঠানিক সনদধারী শিক্ষাবিদ কর্মরত, কিন্তু তাঁদের আলাদা করে দেখার কোনো সুযোগই নেই সেখানে! তাঁদের শিক্ষাবিদ হিসেবে কাজে লাগানো গেলে অন্তত হাতুড়ে শিক্ষাবিদের অনাকাঙ্ক্ষিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে রেহাই পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো।

শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার প্রাচীনতম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯৫ সাল থেকে শিক্ষায় স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রির প্রচলন করেছে। এই প্রতিষ্ঠান এযাবৎ কয়েক হাজার শিক্ষাবিদ তৈরি করলেও দেশের শিক্ষা বিভাগ তাঁদের দক্ষতা কাজে লাগানোর প্রয়োজন বোধ করেনি, যে কারণে এসব শিক্ষাবিদের অনেকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় শিক্ষাবিষয়ক কর্মসূচির উচ্চপদে দক্ষতার স্বাক্ষর রাখা সত্ত্বেও দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার সংকট উত্তরণে তাঁদের ডাক পড়েনি, ডাকা হয়েছে বিদেশি বিশেষজ্ঞদের। সম্প্রতি দেশের অন্তত ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তর ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা হয়েছে। দেশের শিক্ষা খাতে দক্ষ জনশক্তি জোগান দেওয়ার জন্য এটা শুভ উদ্যোগ। এই উচ্চশিক্ষার সুযোগকে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার মূল স্রোতে যুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

দেশের প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য উচ্চতর গবেষণায় যেমন বিনিয়োগ দরকার, তেমনি বিদ্যমান সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে কর্মকেন্দ্রিক গবেষণারও (অ্যাকশন রিসার্চ) প্রসার ঘটানো জরুরি। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় গঠিত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল প্রাথমিক শিক্ষার হাল ধরার মতো দক্ষ জনশক্তি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে। কৃষি, চিকিৎসা, প্রকৌশল কিংবা ব্যবসায় ব্যবস্থাপনার মতো প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়ও যে দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষাবিদের আবশ্যকতা রয়েছে, তা আমরা স্বীকার করিনি। প্রাথমিক শিক্ষকেরা এখনো আত্মপরিচয়ের সংকটে। কেননা, শিক্ষকতা পেশার জন্য কোনো পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই তিনি এই পেশায় নিয়োগ লাভ করেছেন।

শুধু তা-ই নয়, শিক্ষকদের পেশাগত কাজে সহায়তা দেওয়ার নিমিত্তে যে শিক্ষা প্রশাসন বা প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানসমূহ গড়ে তোলা হয়েছে, সেখানেও শিক্ষকতা পেশায় অভিজ্ঞদের কোনো স্থান নেই। শিক্ষা বিষয়ে স্নাতক সম্মানসহ স্নাতকোত্তরের সঙ্গে দুখানা বিদেশি ডিগ্রি এবং প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় অবধি কয়েক বছরের শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা যুক্ত করেও শিক্ষাবিদ হতে না পারাটা নিতান্তই মামুলি ঘটনা এ দেশে। কেননা, এখানে শিক্ষাবিদের প্রয়োজন নেই! যদিও বা কিছু শিক্ষাবিষয়ক পরামর্শের দরকার পড়ে, তার জন্য তো স্বঘোষিত শিক্ষাবিদেরা আছেনই; আরও আছেন পদস্থ কর্তাব্যক্তিরা। অতএব, শিক্ষকের চেয়ে কেরানির কদর বেশি দেখে অবাক হওয়ার বদলে শিক্ষকেরাও কেরানি তৈরির কারিগর হয়ে যান অবলীলায়।

আমি দীর্ঘ দেড় যুগের অধিককাল প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছি। আন্তর্জাতিক সংস্থার চকচকে ক্যারিয়ার ছেড়ে এসেছিলাম। সেই ভাবনার ঘোর হয়তো এখনো কাটেনি আমার। তা না হলে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে সে দেশে শিশুশিক্ষা বিষয়ে পড়ালেখা ও কাজের অভিজ্ঞতাকে পুঁজি করে আবারও আন্তর্জাতিক সংস্থায় কাজের ডাককে উপেক্ষা করলাম কেন? অতঃপর যুক্তরাজ্যে শিক্ষা বিষয়ে আরও একটা স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়া এবং সেই সব অভিজ্ঞতা প্রাথমিক শিক্ষায় কাজে লাগানোর মতো উন্মাদনা আমার হলো কেমন করে? হ্যাঁ, বাংলাদেশ সরকারই আমাকে এবং আমার মতো আরও অনেককে শিক্ষা বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিতে যুক্তরাজ্যে পাঠিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায়। এখন দেখছি আমাকে এখানে কোনো প্রয়োজনই নেই! আমরা উন্নত দেশ থেকে যে শিক্ষা অর্জন করে এসেছি, তা কাজে লাগানোর মতো একটা সুযোগ তো থাকতে হবে বিদ্যমান ব্যবস্থায়।

আমি আমার কর্মস্থলে ফিরে কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার আলোকে সব কাজই করছি আগের নিয়মে; এখানে আমার নিজস্ব জ্ঞানের প্রয়োগাধিকার খুবই সীমিত। উপরন্তু, প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষকদের মানোন্নয়নের নিমিত্তে যে প্রতিষ্ঠানটির জন্ম নিয়েছিল, সেই উপজেলা রিসোর্স সেন্টারও কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি উপযুক্ত ব্যবস্থাপনার অভাবে।

আগামী বছর থেকে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের কাজ শুরু হবে। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা এই শিক্ষাক্রম নিয়ে যেমন আশাবাদ ব্যক্ত করছেন, তেমনি এর বাস্তবায়নে যেসব প্রতিকূলতা রয়েছে, সেই আলোচনাও হচ্ছে মৃদু স্বরে। নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ দক্ষ শিক্ষকের অভাব। কিন্তু সেই অভাব মেটানোর কোনো কার্যকর পদক্ষেপের কথা আলোচনায় নেই। সবচেয়ে সংবেদনশীল শিক্ষাস্তর হলো প্রাথমিক শিক্ষা।

কেননা, এখানেই ভিত্তি রচিত হয় পরবর্তী স্তরের। উন্নত দেশগুলো তাই ভিত্তি মজবুত করার প্রয়োজনে প্রাথমিক স্তরে সব থেকে দক্ষদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ করার ব্যবস্থা করেছে। এদিকে আমরা হাঁটছি উল্টো পথে। প্রাথমিক শিক্ষক এখনো সরকারের নিচের ধাপের কর্মচারী এবং শিক্ষক হয়ে ওঠার কোনো ধরনের প্রেষণাও সেখানে অনুপস্থিত। বরং প্রাথমিক শিক্ষক হিসেবে একধরনের তাচ্ছিল্য সয়ে নিতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছেন এঁরা! এই শিক্ষকদের হাতেই কোনো প্রস্তুতি ছাড়া নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের ভার চাপিয়ে দিয়ে ভালো কিছু আশা করার সুযোগ কোথায়? 

লেখক: জগজ্জীবন বিশ্বাস, শিক্ষাকর্মী

মন্তব্য

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।
Show
 
    সব মন্তব্য

    ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

    এলাকার খবর

     
     

    সিটি নির্বাচনে বিএনপির হার্ডলাইন কিসের ইঙ্গিত

    বাজেটে মানব মর্যাদার বিষয়টি উপেক্ষিত

    উন্মুক্ত বিদ্যা আবশ্যক

    জীবন অগাধ

    রাহমানের ছবি আঁকা

    নারী শিক্ষকও বাদ যান না!

    শিক্ষায় কত অভিঘাত

    ঢাকায় সমাবেশ করার অনুমতি পেল জামায়াত

    ফ্রান্সে ছুরি হামলার ঘটনায় আলোচনার কেন্দ্রে এখন ‘ব্যাকপ্যাক হিরো’

    পৌরসভা ও ইউপি নির্বাচনে আ.লীগের মনোনয়ন পেলেন যারা

    বহিষ্কৃত প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করলে ব্যবস্থা, বিএনপির মনিটরিং সেল গঠন

    বিএনপির সঙ্গে সংলাপের আশার প্রদীপ নিভে যায়নি: কাদের

    অপাত্রে ভোট দিয়ে আর ধোঁকা নয়: খুলনায় হাতপাখার প্রার্থী