ছেলেমেয়ে হারিয়ে নির্বাক রহিচ দম্পতি। এখন শুধুই অনুশোচনা। একটু সাবধান হলে সন্তান দুটো হয়তোবা বেঁচে যেত। নাওয়া-খাওয়া বন্ধ তাঁদের। কারও সঙ্গে কথাও বলেন না। শরীরে স্যালাইন দিয়ে রাখা হয়েছে শিশু দুটির মা সামিনা বেগমকে। বাবা রহিচ উদ্দিন বাড়ির আঙিনায় ঠায় দাঁড়িয়ে আছেন। স্বজন ও প্রতিবেশীরা নানাভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছেন তাঁকে। কেউ আফসোস করে বলছেন, আরেকটু সাবধান হলে হয়তো সন্তানরা বেঁচে যেত। কেউ বলছেন, মারার জন্যই দালালেরা স্রোতের নদীতে জোর করে ঠেলে দিয়েছে।
গতকাল বুধবার শিশুদের বাবা রহিচ উদ্দিনের গ্ৰামের বাড়ি নাগেশ্বরী উপজেলার পশ্চিম সুখাতীতে গিয়ে এমনই দৃশ্যই দেখা যায়। এ সময় রহিচ উদ্দিন বলেন, গত মঙ্গলবার দিবাগত রাত ২টার দিকে সন্তানদের পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়েছে। এ সময় পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী ও জনপ্রতিনিধিগণ উপস্থিত ছিলেন।
রহিচ উদ্দিন আরও বলেন, ‘সন্তানদের নিয়ে সীমান্তের নদী সাঁতরে পার হওয়ার সময় কম সাঁতার জানার কারণে আমার স্ত্রীও পানিতে ডুবে যায়। এ সময় তার পেটে অনেক পানি ঢুকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। এখন সে শ্বাসকষ্ট, মাথা ঘোরাসহ নানা অসুস্থতায় ভুগছে। কথা বলতে পারে না। এমনকি কাউকে চিনতে পারছেন না।’
রহিচ উদ্দিনের মা রহিমা বেওয়া (৬৭) বলেন, ‘আমার এক ছেলে এক মেয়েসন্তান রয়েছে। মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। ছেলে রহিচ ১০ বছর বয়সে তাঁর মামা-মামি ও অন্যান্য প্রতিবেশীর সঙ্গে ভারতে রায়। সেই থেকে আমি একা। বিধবা ভাতার টাকা ও প্রতিবেশীর বাড়িতে চেয়েচিন্তে খেয়ে দিন কাটে। ওখানেই হরিয়ানার এক ইটভাটায় সামিনার সঙ্গে পরিচয় হয় এবং বিয়ে করে। সেখানেই চার সন্তান হাসানুর (১২), রুবিনা (১১) পারভীন (৮) ও সাকিবুরের (৪) জন্ম হয়। কিছুদিন আগে হাসানুর ও রুবিনাকে বাড়িতে রেখে যায়। সবশেষে আমার ডাকে পারভীন ও সাকিবুরকে নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে ডুবে মরে আমার দুই নাতি-নাতনি।’
রহিমা বেওয়া আরও বলেন, ‘আমি মোবাইল ফোনে বাড়ি আসার তাগিদ দিয়ে বলি দেশে ফিরে এলাকায় কাজকর্ম করে সন্তানদের দেখাশোনা করতে। আমার কথাই কাল হলো। এখন বুকের ওপর দুই পাথর তুলে দিছে। কবে যে এ পাথর নামবে।’
রহিচের ফুপাতো ভাই আজিজুল হক জানান, রহিচের ভিটেমাটি এমনকি থাকার ঘর পর্যন্ত নাই। তাঁদের থাকার জন্য একটা ঘর দেওয়া হয়েছে। এখন তাতেই তাঁরা স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন।
আজিজুল হক বাংলাদেশের পাচারকারী দালালদের বিচারের দাবি করে বলেন, ‘দালালেরা টাকা নিলেও দায়িত্ব পালন না করে বিপদের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু বিচার চাই।’
রহিচের মামা মজিবর রহমান বলেন, ‘দালালেরা মারার জন্য নদীর গভীর অংশ দিয়ে ওদের ঠেলে দিয়েছে। ২ শতাংশ জমি কিনে মাথা গোঁজার ঠাঁইয়ের জন্য জমানো টাকা নিয়ে তারা বাড়ি ফিরছিল। টাকাও গেল, সন্তানও গেল। আল্লায় জানে এখন তাদের কী হবে।’
উল্লেখ্য, গত শুক্রবার ভারত থেকে অবৈধ পথে বাংলাদেশে ফেরার সময় বিএসএফের ধাওয়ায় বাবা-মায়ের সঙ্গে নীলকমল নদী সাঁতরে পার হওয়ার সময় স্রোতের তোড়ে পানিতে ডুবে নিখোঁজ হয় ওই দম্পতির দুই শিশুসন্তান পারভীন (৮) ও সাকিবুর। দুই দিন পর রোববার বেলা ৩টায় উপজেলার ধর্মপুর সীমান্তের ৯৪৩ নম্বর আন্তর্জাতিক সীমানা পিলার থেকে ৫০ গজ ভারতের অভ্যন্তরে নীলকমল নদী থেকে বিএসএফ ওই দুই শিশুর মরদেহ উদ্ধার করে।
মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে